Site icon suprovatsatkhira.com

মুক্তমত: ভেঙে গেল মোতালেব বাড়ির আনন্দবাজার

লাল রংয়ের সেই লেটার বক্সটি এখন আর নেই। কেউ চিঠি ফেলতে আসেওনা এখানে। দেয়ালের গায়ে খাড়া হয়ে লটকে থাকা লেটার বক্সটি কবে যে নিউজ বক্সে পরিণত হয়েছে তাও মালুম করা কঠিন। সেই সাথে হারিয়ে গেছে থ্রি সেভেন ফাইভ (৩৭৫) নম্বরের টেলিফোনটি। আড্ডা গল্পবাজি আত্মীয়তা সবই যেনো উঠে গেছে। এভাবেই ভেঙে গেল একটি আনন্দবাজার। যে বাজার একদিন হয়ে উঠেছিল নদীর মোহনার মতো, বহুধারার সংযোগ। যেখানে মিলিত হতো সব ধর্ম বর্ণের মানুষ। আনন্দ উৎসবে ভালবাসায় মেতে থাকতেন তারা।
বৃহস্পতিবার সকালে এমন সুনসান নীরবতা অনুভূত হলো শহরের মনজিতপুরে ১ কেবি আহসানউল্লাহ রোডের বাড়িতে। এই বাড়িতেই বসতি গড়ে ওঠে আবদুল মোতালেব ও তার সহধর্মীনি আমিনা বেগম দম্পতির। মহাকালের গতিতে তারা দুজনেই আজ প্রয়াত। গাঢ় আকাশি নীল রংয়ের দ্বিতল বাড়িটি এখন এক স্মৃতিপুরী। দেয়ালে দেয়ালে কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা পড়েছেন বাড়ির সদস্যরা। এক পাশ জুড়ে রয়েছে দৈনিক কাফেলা। রয়েছে প্রিন্টিং প্রেস। কাজ চলছে দিন-রাত। কিন্তু আজ বাড়িময় কেবলই শোকের আবহ। বাতাসেও করুন সুর। প্রেসে শব্দ নেই। পত্রিকায় লেখার ভাষা নেই। কেউ কাঁদছেন কেউ দোয়া করছেন কেউ স্মৃতি চারণ করছেন। কেউ আত্মীয়তার বাঁধনের কথা বলছেন, বলছেন নিজের কথা, পরের কথা, পেশার কথা। সমসাময়িক অনেক বিষয়ের কথা। স্কুল-কলেজের কথা। বলছেন জীবন সংগ্রামের কথা। সবার কথা এক মোহনায়। কেউ বলেন মোতালেব ভাই আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমার সুবিধা অসুবিধা দেখতেন। আমাকে চাকুরি দিয়েছেন। কারও ভাষায়, খালা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ছেলে মেয়ে অথবা ভাই বোনের মতো দরদমাখা আচরণ করতেন। পিনপতন নীরবতার মধ্যে স্বজনদের চোখেমুখে মাতৃহারার বেদনা ফুটে উঠেছে। তাদের চোখে মুখে মা হারানোর বেদনা লাল রং নিয়ে ফুটে উঠছিল। ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদে উঠছিল তাদের হৃদয়। সবার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে তাদের মাথার ওপরকার ছাদ সরে গেছে। আজ থেকে একটি ছাদহীন বাড়ির বাসিন্দা তারা।
এরই মধ্যে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকে হিম শীতল কফিনে শায়িত অবস্থায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় ফিরলেন মিসেস আমিনা বেগম। দৈনিক কাফেলার সম্পাদক তিনি। সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের চাকুরি শেষে অবসরপ্রাপ্ত আমিনা ভাবী। সশ্রদ্ধচিত্তে তার কফিনে ফুল দিলেন গুণগ্রাহী মানুষ। মুহূর্তেই বাড়িটি হয়ে উঠলো হাজার মানুষের অশ্রু বিসর্জনের আঙিনা। এরপর শহিদ আবদুর রাজ্জাক পার্কে জানাযার নামাজে যোগ দিলেন শত শত মানুষ। এরপর অন্তিম যাত্রায় তিনি রসুলপুরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন স্বামী আবদুল মোতালেবের পাশে।
পঞ্চাশের দশক থেকে জমে উঠেছিল বাড়িটি। এই বাড়িতেই বসেছিল একটি প্রিন্টিং প্রেস, আহমাদিয়া প্রেস। শত প্রকারের প্রকাশনা বের হতো এখান থেকে। ছাপা হতো বই, প্রশ্নপত্র, লিফলেট, ভোটের পোস্টার কত কিছু। সাথে সাথে রাত পোহাতেই প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক কাফেলা, পরে দৈনিক কাফেলা। এই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক ও বরেণ্য শিক্ষানুরাগী সমাজসেবক হিসাবে আবদুল মোতালেবের বিচরণ ছিল সাতক্ষীরার গ-ি ছাড়িয়ে দেশজোড়া। আর তার সহধর্মীনি আমিনা বেগম ছিলেন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই দুইয়ের সমন্বয়ে বাড়িটি হয়ে ওঠে যেনো উৎসবের আনন্দবাজার। নানা কাজ কথা নিয়ে নিত্য মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িটিতে। আপদে বিপদে সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় আড্ডায় আপ্যায়নে বাড়িটি হয়ে থাকতো জমজমাট। দূরের মানুষ হতো নিকটজন। আত্মীয়তার বন্ধন হয়ে উঠতো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। দৈনিকের খবরের কাগজ পড়ার এক চমকপ্রদ আড্ডা ছিল এই মোতালেব বাড়ি, কাফেলা বাড়ি।
এই বাড়িতেই ক্রিং ক্রিং করে ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠতো টেলিফোন থ্রি সেভেন ফাইভ। জোরে জোরে শোনা যেত তাদের কথোপকথন। শোরগোল উঠতো নানা কথার। সেই যে সকাল থেকে শুরু হতো কর্মযজ্ঞ আর তা শেষ হতো রাতে। এভাবে দিনের পর দিন আহমাদিয়া প্রেস আর প্রেসসংলগ্ন বাড়ি যেনো জমে থাকতো। বলতে কষ্ট হয় ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই। নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে, নেই তারা আজ কোনো খবরে’। সাতক্ষীরার সেই কফি হাউসে যেনো আর বসেনা আনন্দবাজার। মিলিত হয় না এক মোহনায়। ভেঙে গেছে সেই আনন্দবাজারটি।
অগ্রজ সাংবাদিক প্রয়াত হয়েছেন ২০০২ সালে। তারপর কেটে গেছে আরও ১৬টি বছর। গৃহকর্তার অনুপস্থিতি তার সহধর্মীনি গৃহকত্রীকে হতাশ করে দিয়েছিল। অবশেষে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিও চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। সেই সাথে এই বাড়িতে যাতায়াতের পথও উঠে গেল। এই পথে আর জট থাকবে না। এই পথে মোহনা তৈরি হবে না। এখানে বাজবে না টেলিফোন থ্রি সেভেন ফাইভ। আত্মীয়তা আপ্যায়নে আড্ডায় বাধা পড়বে না মানুষ। তাদের সুখ দুঃখের কথা তাদের ভালবাসার কথা তাদের আপদ বিপদের কথা আর শ্রুত হবে না।
আনন্দবাজার ভেঙে হবে সুনসান নীরবতার এক বাড়ি, মোতালেব বাড়ি। কাফেলা বাড়ি। আহমাদিয়া প্রেসের বাড়ি। এখন এখানে শুধু স্মৃতিই কথা বলবে। লেখক: সুভাষ চৌধুরী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, এনটিভি ও দৈনিক যুগান্তর, সাতক্ষীরা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version