Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: সারাদিন সম্মুখ যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে

সৌমেন মজুমদার, তালা: বীর মুক্তিযোদ্ধা নজির উদ্দিন মোড়ল। সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেতুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নজির উদ্দিন মোড়ল পড়ালেখায় খুব বেশি দূর এগুতে না পারলেও দেশের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা থেকেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন তিনি। যুদ্ধে যোগদানের পর ৭ বার পাক হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার পর আমার শরীরে আগুন ধরে যায়। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে- যেভাবেই হোক দেশকে বাঁচাতে হবে পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে চলে যাই চিংড়ি, আমার মামার বাড়িতে। সেখান থেকে ঝাউডাঙ্গা হয়ে হাকিমপুর বর্ডার দিয়ে পার হয়ে চলে যাই বশিরহাট। আ স ম আলাউদ্দিন স্যার এর হাত ধরে ভর্তি হই তকিপুর যুদ্ধ ট্রেনিং ক্যাম্পে। সেখানে ২০ দিন ট্রেনিং শেষে চলে যাই বিহার প্রদেশের সিংভুম জেলার চাকুলিয়া বিমান বন্দরে গেরিলা ট্রেনিং এর জন্য। ১ মাস ৫ দিন ট্রেনিং শেষে ফিরে আসি ইটিন্ডা ক্যাম্পে। ক্যাম্পে কয়েকদিন থেকে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্যে। গভীর রাতে কাশীপুর ও কুমিরা মধ্যবর্তী বাহাদুর নদী পার হয়ে বাড়ি পৌঁছানোর পর সবার চোখে মুখে একই প্রশ্ন। এতদিন কোথায় ছিলাম? তখন কারো সাথে কিছু বলিনি। মিথ্যা বলেছিলাম বাড়িতে- আবাদে কাজ করি, সেখানে বিয়ে করেছি। আরও অনেক মিথ্যা। কিছুদিন বাড়ি থেকে আবার ফিরে যাই ইটিন্ডা ক্যাম্পে। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুব স্যার তৎকালীন ৮নং সেক্টরের তালা, কলারোয়া ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের ম্যাপ পয়েন্ট করতে আবার বাংলাদেশে পাঠান। বিশেষ করে মঙ্গলকোট ব্রিজ, পাটকেলঘাটা ব্রিজ এবং বিনেরপোতা ব্রিজের ম্যাপ পয়েন্ট করা জরুরী ছিল। ম্যাপ পয়েন্ট নিয়ে ইটিন্ডা ক্যাম্প এ ফিরে গেলে আমাকে আবার পাঠিয়ে দেন কপিলমুনি রাজাকার ঘাটির ম্যাপ পয়েন্ট করতে। আমি আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে কপিলমুনি রাজাকার ঘাটিতে যেতে সক্ষম হই। রাজাকার ঘাটির এক দিদির সহযোগিতায় আমি ওই বাড়ির ম্যাপ পয়েন্ট খুব সহজেই পেয়ে যাই। রাজাকাররা ওই দিদিকে উঠিয়ে এনে আটকে রেখেছিলো। ম্যাপ পয়েন্ট নিয়ে আমি আবার ফিরে যাই ভারতে। এরপর আমাকে অপারেশন পার্টি কমান্ডার করে অস্ত্র দিয়ে সাতজনকে যুদ্ধের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়। আমরা প্রথমে সরুলিয়া কুঠিঘাটা বাজারে অবস্থান নেই। তারপর আমরা প্রথমেই ভোমরা হানাদার ঘাটির টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। তারের খুটিতে ডিনামাইট ফিট করে খুটি মাটিতে ফেলে সমস্ত তার সরিয়ে ফেলি। যখন টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তারপর থেকে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। ৯নং সেক্টরের মেজর এমএ জলিলের নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করি। আমি কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প, ঝাউডাঙ্গা মাদ্রাসার রাজাকার ক্যাম্প, কাজিডাঙ্গা বারাত, ভোমরা হানাদার ক্যাম্পসহ সাত জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কাজিডাঙ্গার বারাত গ্রামের যুদ্ধ আমার যুদ্ধ জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন ছিলো। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৬টার পর থেকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চারিদিক থেকে এক নাগাড়ে গুলি চালাতে থাকে। আমরা ছিলাম মাত্র ১৩ জন। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পিছুপা না হয়ে আমরাও পাল্টা গুলি চালাতে থাকি। এভাবে এক টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত গোলাগুলির পর পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে যায়। আমরা একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কম কম গুলি করতে থাকি। ওরা ১০ রাউন্ড গুলি ছুড়লে আমরা ২ রাউন্ড গুলি করি কিন্তু টার্গেট করে। আমার সম্মুখ যুদ্ধের সব থেকে লম্বা সময় ছিলো সেদিন।
এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। আমরা পেলাম আমাদের লাল সবুজের পতাকা।
চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, সবাইকে বলে দিও কেউ যেন মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান না করে। দেশের পতাকাকে অসম্মান না করে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version