শিশু বয়সে শিক্ষকরা আমাদের শিখিয়েছেন, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি’। শিক্ষকরা আরও শিখিয়েছেন, ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও মিথ্যা কথা বলিবে না’। দেশের আদালত আমাদের শিখিয়েছে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলুন, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’। আর দেশের সংসদীয় নির্বাচন আমাদের শিখিয়েছে ‘হলফনামা’। এই হলফনামায় সত্য কথা লিখবার বিধান দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
শিক্ষকদের উপদেশ আর আদালতের নির্দেশ নিয়ে আমার নতুন করে বুঝবার কিছু নেই। সুতরাং তা নিয়ে আমার আলোচনাও নয়। আমি অবুঝ ‘হলফনামা’ নিয়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসেছে। আর ‘হলফনামা’ নিয়ে বেশ নাড়াচাড়াও শুরু হয়েছে। আমি সাহিত্য সংসদের বাংলা অভিধান ঘেটে খুঁজে পেলাম ‘হলফ’ শব্দটি। এর অর্থ লেখা হয়েছে ‘সত্য বলিবার জন্য শপথ বা ঈশ্বরের নামে দিব্য’। হলফের অর্থ যখন বুঝলাম তখন এর ভেতরে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। আমি খবরের কাগজ ঘাটাঘাটি করেছি। দেখলাম হলফনামার সে কী তোড়। নিজের ও পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক সুখ শান্তি হয়তো কারও কারও কপালে জোটে না। কিন্তু কিছু লোকের ভাগ্যের লিখনে তো বলা হয়েছে, তার শান শওকত মান মর্যাদা টাকা পয়সা ধন দৌলতের কথা। এসবই তো ভাগ্যের। কিন্তু ভাগ্যের এই লিখনকে কেনো আমরা ধামাচাপা দেই তা জানা দরকার, জানানোও দরকার। কেনো নিজের ধন দৌলত ফেলে নিজে দরিদ্র সাজি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট পেতে আমরা ছুটাছুটি শুরু করেছি। নির্বাচন কমিশন আমাদের ভোট নেওয়া দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এ জন্য কিছু নিয়ম কানুন আইন ইত্যাদি রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর একটি অনুসঙ্গ হলো ‘হলফনামা’। এই হলফনামা যে প্রার্থী না দেবেন তিনি তার প্রার্থীতা হারাবেন এটাই আইন। কিন্তু হলফনামায় তথ্য গোপন করে কম অথবা বেশি দিলে বিশেষ করে স্থাবর অস্থাবর সম্পদ নিয়ে সত্য গোপন করলে প্রাথমিক দৃষ্টিতে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ নাও হারাতে পারেন।
২০০৮ এর নির্বাচনে একজন ধর্ণাঢ্য প্রার্থী তার হলফনামায় বলেছিলেন, তার ঘরে ৩০০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে। যার দাম তিন হাজার টাকা মাত্র। একথা শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ধনশালী ওই প্রার্থীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম আপনার ঘরে কি মাত্র ৩০০ ভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে। আর তার দাম তিন হাজার টাকা মাত্র। তিনি বললেন, আমি হলফ করে বলছি বৃটিশ আমলে তোমাদের চাচীকে যখন বউ করে ঘরে তুলি তখন উল্টো পোন (যৌতুক) দিতে হয়েছিল আশি টাকা। আর আমার শ্বশুর আমাকে ও তোমাদের চাচীকে যে স্বর্ণালংকার দিয়েছিলেন তার ওজন ৩০ ভরি। পরে বৌভাতে গিফট পেয়েছিলাম শুধুই স্বর্ণালংকার। সব মিলেয়ে ৩০০ ভরি হয়েছে। তখনকার বাজারে এর দাম ছিল ১০ টাকা ভরি হিসাবে ৩০০০ টাকা। তো আমি আমার হলফনামায় ৩০০০ টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকারের তথ্যই দিয়েছি, ভুল করলাম কোথায়? কারণ আমার ঘরে যা আছে তাতো আর বাজারের বেচাকেনার জন্য নয়, যে তার এখনকার দাম বলতে হবে। তাহলে তো বলতে হয় বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দাম। সুতরাং হলফনামায় আমি মিথ্যা বলিনি, সত্য কথাই বলেছি। নির্বাচনে আমার সেই চাচা এমপি হয়েছিলেন। এতো গেল ২০০৮ এর নির্বাচনের কথা। এবারের নির্বাচনের কথায় আসি। পত্রিকান্তরে জানতে পারলাম মনোনয়ন দাখিলকালে প্রার্থীরা হলফনামায় তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন। তাতে কেউ বলেছেন, আমার কোনো বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, জমিও নেই। আছে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কেউ বলেছেন, আমার বাড়ি নেই। স্ত্রীর বাড়িতে থাকি। কেউ লিখেছেন আমার গাড়ি নেই। স্ত্রীর দেওয়া গাড়ি আমি চড়ি। কেউ বলেছেন আমার কোনো আয় নেই। স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের আয়ে আমার সংসার চলে। কারও কারও বয়ান আমার নামে কোনো ব্যাংক ব্যালান্স নেই। কোনো কোনো প্রার্থী লিখেছেন তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে কিংবা ছেলে অথবা মেয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেল আমাদের প্রার্থীদের উল্লেখযোগ্য কোনো স্থাবর অস্থাবর সম্পদ নেই। যা আছে সবই স্ত্রীর নামে। তাদের হলফনামায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সবাই স্ত্রীর কেয়ার অবে থাকেন। স্ত্রীর অর্থে কেনা ডাল ভাতে নিত্যদিন শরিক হন তিনি। এক কথায় বলা যায় প্রার্থীর চেয়ে তার স্ত্রীর সম্পদ বেশি। তা হলে বোধ হয় বলা যায় বিয়ের সময় তারা তাদের শ্বশুরের কাছ থেকে যৌতুক নিয়েছেন। তবে সব প্রার্থীই যে হলফনামায় নিজের সম্পদহীনতা কিংবা সম্পদ কম দেখিয়েছেন তা কিন্তু নয়।
কথায় আছে ধনকুবেররা বড়ই কৃপণ সাজেন। তাদের মাথায় তেল থাকে না। বলেন, এটা নেই সেটা নেই। কারণ দেওয়ার ভয়। তারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সেই কার্পণ্যের কথাগুলোই লিখেছেন হলফনামায়। বলেছেন, আমার যা সম্পদ ছিল তাও কমে গেছে। এর কয়েকটি কারণ আছে বলে আমার বিশ্বাস।
০১. ধনকুবেররা মনে করেন আমার বেশি অর্থ সম্পদ আছে জানতে পারলে দিনে বা রাতে ঘরে ডাকাত পড়তে পারে।
০২. আমার সম্পদের সঠিক হিসাব দিলে সরকারের ঘরে বেশি মাত্রায় কর দিতে হতে পারে।
০৩. ঘরের সম্পদের কথা বেশি জানানো হলে চারদিক থেকে নজর পড়তে পারে এবং সম্পদ লুটে পুটে নেওয়ার পথ খুঁজতে পারে।
০৪. আমার সম্পদ অনেক বেশি এটা জানতে পারলে ভিক্ষুকরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ভিড় করতে পারে। ০৫. বেশি সম্পদের খোঁজ পেলে দুদক আমাকে খুঁজতে পারে।
০৬. আমার সম্পদ বেশি আছে জানতে পারলে কোনো বিশেষ বাহিনী এসে রাতে তুলে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করে নিতে পারে। অতএব তার থেকে বরং ভালো কৃপণ হয়ে যাওয়া। অন্ততঃ নির্বাচন পর্যন্ত গরিব সেজে থাকাই শ্রেয়।
নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৭৮ জন এবং বিএনপির ৫৫৫ জনের মনোয়নপত্র বৈধ ঘোষিত হয়েছে। আপিলের মাধ্যমে এই সংখ্যা হয়তো আরও বাড়বে। আমি হলফ করে বলতে পারি, প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় সব সত্য বলেন নি। তারা নিজেরাই কৃপণ সেজেছেন। কারণ তাদের সামনে পেছনে ভয় আছে চোর ডাকাত কিংবা লুটেরা ও ছিনতাইকারীর। এই হলফনামায় যদি সত্য বচনই না লিখলাম তাহলে এর নাম ‘হলফনামা’ বদলে অন্য কিছু লিখলে ভালো হয়। কারণ এতে শিক্ষক যা শিখিয়েছেন তা মানা হয়নি। আদালত যা বলেছেন তাও অমান্য করা হয়েছে। অতএব সংসদ বাংলা অভিধান খুঁজে দেখা যাক ‘হলফনামা’ পাল্টে অন্য কোন শব্দ কি লেখা যায়।
কারণ আমাদের শিশু কিশোররা দেখছে আমাদের গাড়ি বাড়ি শান শওকত মান মর্যাদা। আমাদের বিলাস ভূষণ সবই আসছে তাদের নজরে। তারাই দেখছে আমাদের বিমান ভ্রমণ, দেখছে আমাদের খাবার টেবিল, আকাশচুম্বী বাড়ি। আর সেই শিশুরা দেখছে আমাদের ‘হলফনামা’।
পাঠক এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজে। নতুন প্রজন্ম ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও মিথ্যা বলিবে না’ এর উল্টোটাই মাথায় ধারণ করতে পারে। বলে রাখা ভালো নির্বাচনে জেতা কিংবা হারার পর সেইসব প্রার্থীকে হয়তো ‘হলফনামা’র মতো ‘দরিদ্র’ দেখা যাবে না। তাদের ধন দৌলতের বিলাস ভূষণের চেহারা তখন উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। প্রার্থী তখন কি বলবেন। লেখক: সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি
মুক্তমত: আমিও হলফ করিয়া বলিতেছি যে-সুভাষ চৌধুরী
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/