Site icon suprovatsatkhira.com

আজ কপিলমুনি মুক্ত দিবস

প্রবীর জয়, কপিলমুনি (খুলনা): আজ ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস। এদিন খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি রাজাকার মুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টার সম্মুখ যুদ্ধে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পতন ঘটেছিল দক্ষিণ খুলনার সবচেয়ে সমালোচিত ও বড় রাজাকার ঘাঁটির। এসময় উপস্থিত হাজার হাজার জনতার সিদ্ধান্তে ১৫৬ জন রাজাকারকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিমত যুদ্ধকালীন এত সংখ্যক রাজাকারদের জনতার সিদ্ধান্তে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত সেটাই প্রথম।
তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দোসররা দেশব্যাপী সাধারণ নিরিহ মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে উঠে। এ সময় পাক দোসররা বিশাল অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কপিলমুনিতে ঘাঁটি করে। অত্যাচারী বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনি শহরে পরিত্যক্ত রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানী দোসররা ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়। তখন এলাকায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন বিকাল ৪ টা থেকে ভোর ৬ টা নাগাদ কার্পোজারী করা হত। এলাকার নিরিহ মানুষদের ধরে এনে কপোতাক্ষ নদ তীরে ফুলতলা নামক স্থানে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবণ দেয়া হত। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়–লী, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ইখালী প্রতিরোধ দুর্গোকে মুক্তিফৌজের ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। তাগিদ পড়ে কপিলমুনি শত্রু ঘাটি পতনের। কারণ খুলনাঞ্চলের মধ্যে কপিমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে ৩ শ’র বেশি পাক সেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। ছাদের উপর তাক করা হয় ভারী কামান ও মেশিন গান। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর খুলনাঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রে মিলিত হন মাগুরার শান্তি বাবুর দোতলায়। সিদ্ধান্ত হয়, যে কোন মূল্যে কপিলমুনিকে মুক্ত করতেই হবে। এর আগে আরো একবার শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ হলেও জনতার অসহযোগিতায় ব্যর্থ হয় পরিকল্পনা। পাইকগাছার রাড়–লী ও হাতিয়ারডাঙ্গা ক্যাম্প কমান্ডারগণ যুদ্ধের একটি পরকল্পনা প্রণয়ন করেন। নৌ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী রহমত উল্ল¬া দাদু, স.ম বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, মোল্যা আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রুঘাটি আক্রমন করা হয়। হঠাৎ রাইফেলের গুলির ঠাশ-ঠাশ আওয়াজ মুহুর্তে ভারী অস্ত্র কামান, মেশিনগানের বিকট শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় মানুষের। যার যার মত বাড়ির বারান্দার নীচে পজিশন নেয় প্রাণ ভয়ে। স্থানীয় প্রতাপকাটী কাঠের ব্রীজের উপর ৮ জন রাজাকার, তার একটু পেছনে আরো ৫ জন রাজাকার যুদ্ধে মারা যায়। একের পর এক মরতে থাকে পাক দোসর রাজাকারদলের সদস্যরা। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১ টার দিকে অস্ত্র ফেলে ১৫৬ জন পাকিস্তানী দোসর আত্মসমর্পণ করে। সাথে সাথে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাঁটির। শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের ঐতিহাসিক ময়দানে। এখবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে সেখানে। উপস্থিত জনতার গণদাবির প্রেক্ষিতে তাদেরকে প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এসময় অধিকতর অপরাধীদের ১১ জনকে চিহ্নিত করে আলাদাভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ও রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ঐ দিন নিহত রাজাকারদের অধিকাংশ পরিবার তাদের লাশ বুঝে নিলেও লজ্জা, ঘৃণাসহ নানা কারণে অনেকের লাশ গ্রহণ করেনি তাদের পরিবার। তাদেরকে মাঠের পশ্চিম প্রান্তে গণকবর দেয়া হয় বলেও সূত্র জানায়।
দীর্ঘদিন সেখানে এলাকাবাসী মূত্র ত্যাগ করত। এযুদ্ধে শহিদ হন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা খুলনার বেলফুলিয়ার আনোয়ার হোসেন ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের আনছার আলী গাজী। আহত হন মোহাম্মদ আলী, তোরাব আলী সানাসহ অনেকে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version