Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: ৩টি বড় ধরণের রাজাকার ঘাটি ধ্বংস করি

এসএম নাহিদ হাসান: আবু বকর সিদ্দিক। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বল্লী ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিক বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরের উত্তর কাটিয়া এলাকায় থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে তিনি বলেন, সময় তখন ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ২৫ শে মার্চ যখন বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি বাহিনী হামলা শুরু করলো তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। স্বাধীনতা ঘোষণার পর এ খবর দ্রুত সাতক্ষীরায় চলে আসে। ২৭ মার্চ সকাল ৯টা-১০টার দিকে গ্রামের বাজারে এসে দেখি একজন ইপিয়ার সদস্যের জামা-কাপড়ে রক্ত লেগে আছে। তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা এখনো বসে আছো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেছে, সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তোমরা বসে থেকো না। এই ইপিয়ারের কথাগুলো আমার যুদ্ধে যেতে বেশ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো। আমার বয়স তখন ২০-২১ বছর। বছর খানেক হয়েছে বিয়ে করেছি। তখন আমি গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। সবকিছু পিছনে ফেলে দেশের জন্য যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
২৮ মার্চ আমাদের কাছে খবর আসে যশোরের পালপাড়ায় কিছু বাঙালি পাকিস্তানিদর বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এ খবর শুনে এলাকার কয়েকজন মিলে একত্রিত হয়ে একটি ট্রাকে কিছু খাবার নিয়ে যশোর পালপাড়ায় তাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। ফেরার সময় দেখি যশোরের চাচড়ার মোড়ের বাড়িঘরগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়েছে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে যোগাযোগ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের হাকিমপুরে চলে যায়। সেখান থেকে এমএলএ মমতাজ সাহেব আমাদের টাকিতে পাঠান। টাকিতে কয়েকদিন থাকার পর আমাদের ভারতের ঘোজাডাঙ্গায় পাঠানো হয়। এই ঘোজাডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হয়।
তিন-চার দিন পর আমাদের সেই ক্যাম্প সরিয়ে ইটিন্ডার আমবাগানে নেওয়া হয়। এখানে আমাদের ১০-১৫ দিন ধরে হালকা অস্ত্র, রাইফেল, গ্রেনেড চালানো শেখানো হয়। আমাদের ক্যাম্পটি সীমান্ত থেকে বেশ দূরে ছিলো। সীমান্ত দিয়ে অনেকগুলো বাঙ্কার করা ছিলো। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এ বাঙ্কারে থেকে পাহারা দিতাম। রোদ বৃষ্টিতে উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
২৮ মে ১৯৭১, ক্যাম্পে অবস্থানকালীন হঠাৎ রাত তিনটার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের উপর হামলা চালায়, শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। সকাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে তিন থেকে সাড়ে তিনশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্য মারা যায়। আমাদের দুই ভাই শহীদ হয়। পরে আমরা পাকিস্তানিদের তিনটা লাশ আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসি। তাদের ভিতর একজন অফিসার র‌্যাংকের ছিলো।
এরপর জুন মাসে ভারতের বিহার থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। এখানে এলএমজি, এসএমজি, ইন্ট ট্যাংকার মাইন, গ্রেনেডসহ ভারি অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হয়। পাশাপাশি ব্রিজ, বাড়ি, বড় বড় ভবন ধ্বংস করার কৌশল শেখানো হয়। এ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। আমাকে কলারোয়া উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পাবার পর উপজেলার গয়ড়া বাজারের ইদ্রিস আলীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এসময় গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল গফফার ও মসলেমের নেতৃত্বে ৩টি বড় ধরণের রাজাকারের ঘাটি ধ্বংস করা হয়। নভেম্বর মাসের দিকে বাগাচাড়া পোস্ট আফিসের ভিতর রাজকাররা অবস্থান করতো। তাদের এ ঘাটিতে অপারেশনের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। মাত্র চারজন সঙ্গী নিয়ে সেখানে আক্রমণ করে ১৬-১৭ জনের একটি দলকে জীবিত আটক করে আমাদের ক্যাম্পে আনি। গয়ড়া বাজারের চন্দনপুর হাইস্কুলের ২য় তলায় আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিলো। পরে জীবিত রাজাকারদের ৮নং সেক্টরের হেড ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এসব অপরেশনে ফকিরহাটের বিমল বসুর ভূমিকাও ছিলো উল্লেখ করার মত। কলারোয়াতে থাকাকালীন এখানকার মানুষ আমাদের খাবার দিয়ে, থাকার জায়গা দিতে, ওষুধ-পানি দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমাদের ইউনিটে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। তাদের প্রত্যেককে কেউ না কেউ আশ্রয় দিতো। সকলের সহযোগিতায় আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি।
তারপর আমি, আব্দুল গফফার, মাজেদ, বিমল বসু, আব্দুল মাজেদসহ আরও কয়েকজন মিলে তালা উপজেলার খলিশখালি, সরুলিয়া, কলারোয়ার হাজিপুর, মুরারিকাটি, সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গায় গেরিলা অপারেশন চালিয়ে শান্তিবাহিনী, রাজাকার, আলবদরদের হত্যা করা করি। সকল জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা যেতো না। আলবদররাই চিনিয়ে নিয়ে যেতো।
এভাবে আমাদের অপারেশন চলতে থাকে। অবশেষে ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে সাতক্ষীরা শত্রুমুক্ত হয়।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version