Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: মাহমুদপুর স্কুল ছিল পাকসেনাদের কসাইখানা

এস.এম নাহিদ হাসান: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী বন্দরগ্রাম ভোমরা। উত্তরে লক্ষ্মীদাড়ি। পশ্চিমে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা। দক্ষিণে শাঁখরা। ঠিক বন্দরগেট থেকে বিজিবি চৌকি বরাবর দক্ষিণের উঁচু বেড়িবাঁধ দিয়ে দুশো গজ এগোলে বাঁশবাগান ঘেরা সূর্যকান্ত ঘোষের বাড়ি। তবে বাংলা ১৩৫২ সালে নির্মিত বাড়িটি বিনিময়ের মাধ্যমে শমসের আলীর হয়ে যায় দেশবিভাগের কিছুদিন পরেই।
এ বাড়ি থেকে আবার ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত তিনশো গজের মতো। বাড়ির পাশের ওয়াপদার উঁচু মাটির বেড়িবাঁধে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকার। সেই বাংকারে একবার যেতো পাকিস্তানিদের দখলে, পরে তা যেতো মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। এ এলাকায় ভারী অস্ত্র নিয়ে দাপটের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন গেরিলাযোদ্ধা মো. মুছা আমিন ও তার দল। ৪৫ বছর পরও এ বাড়িকে কেন্দ্র করে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার আদ্যপান্ত তার ঠোঁটের ডগায়। এ বাড়িটিই ঝাঝরা হয়ে আছে গুলির দাগে।
এখনও শত শত গুলির দাগ, শেলের আঘাতের চিহ্নবাহী বাড়িটির বর্ণনা দেবার আগে ভোমরার সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ঘটনাটি ২৯ এপ্রিলের। এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তখন সবেমাত্র সংগঠিত হচ্ছেন। কেউ নতুন প্রশিক্ষণ নিয়ে কেবল এসেছেন, কেউবা দেশেই কোনো রকম অস্ত্র চালানো শিখেছেন।
ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দীন ছিলেন ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর ভোমরার দায়িত্বে। এ সেক্টর এবং ভোমরার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ক্যাপ্টেন মাহবুব। শেলের আঘাতে ভেঙে যাওয়া একটি অংশ ইট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানিরা সাতক্ষীরা থেকে কুলাটি নবাবকাঠি থেকে এসে ভোমরায় অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন তাদের তুলনায় সংখ্যায় কম। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিলো ওয়াপদা বেড়িবাঁধের উপর থেকে লক্ষ্মীদাড়ি পর্যন্ত। একেবারে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষে। পাকিস্তানিরা বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রচ- আক্রমণ শুরু করে। তাদের শেলের এতো জোর ছিলো যে, কোনো কোনোটি ভারতের মৈত্রীবাগান কলেজ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে। প্রবল যুদ্ধ হয় টানা ১৭ ঘণ্টা।
সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় বাহিনীও শেল ছুড়ে জবাব দেয়। তাতে বড় সহায়তা পান মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু এক পর্যায়ে গোলা-বারুদ শেষ হয়ে যায়। কয়েকশো অস্ত্র দখল করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় মুক্তিবাহিনী। দখল হয়ে যায় বেড়িবাঁধটি। এ যুদ্ধে শামসুল হক ও দেবহাটার আবুল কাশেমসহ চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ভোমরার এই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তরিক উল্লাহ। প্রবল গুলিবৃষ্টির মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ ও শহীদ হন। পরে তার লাশ উদ্ধার করে সমাধিস্থ করা হয় ভারতের মাটিতে।
এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুছা আমিনসহ তার সঙ্গী ১৩ জন ট্রেনিং নেন ভারতের বিহারের চাকুলিয়ায়। অবশ্য যখন যুদ্ধ করেছিলেন তখন সম্বল ছিল স্থানীয়ভাবে পাওয়া ট্রেনিং। তাদের দক্ষতা দেখে পরে পাঠানো হয় উচ্চতর ট্রেনিংয়ে। চাকুলিয়ায় ২৮ দিনের ট্রেনিংয়ে সুবেদার নিরঞ্জন সিং, ক্যাপ্টেন মিশ্রজিৎ তাদের অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন যুদ্ধকৌশল শেখান।
এই বড় যুদ্ধের মাসখানেক পরে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেই দখল হারানো ওয়াপদা বেড়িবাঁধ দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করেন মুছা আমিনরা। ক্যাপ্টেন মাহবুব ছিলেন নেতৃত্বে। পরিকল্পিতভাবে কৌশলে দখল করতে সক্ষমও হন। দখলের পর দুপুরের দিকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ১০-১৫জনের একটি দল। দলে ছিলেন ইপিআরের সুবেদার জব্বার। আচমকা বাঁধের ৫০ গজ দূরের একটি দোতলা বাড়ি থেকে গুলি এসে বেঁধে জব্বারের পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গোলাগুলি।
গুলিতে ঝাঁঝরা হতে থাকে বাড়িটির দেয়াল। তখনও মুক্তিবাহিনী জানতো না বাড়ির ভিতরে কারা কিংবা কতজন আছে। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী বাড়িটির চারপাশ ঘিরে আক্রমণ চালাতে থাকে। একটি শেলে বাড়িটির দোতলার উপরের চিলেকোঠাটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। গোলায় উড়ে যায় দোতলার কিছু অংশ।
পরে জানা যায়, আসলে একজন পাকিস্তানি সৈন্য ওই বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। সে-ই গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান সুবেদার জব্বার।
সূর্যকান্ত ঘোষের সেই বাড়ির দেয়ালে স্যাঁতলা জমলেও এর বর্তমান বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম শেলে উড়ে যাওয়া অংশটির মেরামত ও সামনের দিকের গোলার দাগে প্লাস্টার করা ছাড়া তেমন কোনো সংস্কার করেননি।
অসংখ্য গুলির দাগ সমস্ত বাড়িজুড়ে। বাড়ির ভিতরটা এখনও যেন অতীতের গন্ধবাহী। প্রাচীন আমলের বড় বড় সিঁড়ির ধাপ বেয়েই উঠতে হয় ছাদে। শেলের আঘাতে যে অংশ গুঁড়িয়ে গিয়েছিলো, সেই অংশটি আটকে দেওয়া হয়েছে ইট দিয়ে। তবে প্লাস্টার না করায় সে ক্ষতও এখনও দগদগে। বাড়ির বাসিন্দারা সবাই মানিয়ে নিয়েছেন এ পরিবেশের সঙ্গে। ঠিক নস্টালজিয়া থেকে কিনা তা তাদেরও জানা নেই।
এই বাড়িটি থেকে চার কিলোমিটার দূরে মাহমুদপুর স্কুল। স্কুলটি একাত্তরে পরিচিত ছিল পাকসেনাদের কসাইখানা হিসেবে। এই তো ২০১২ সালেও নতুন একটি ভবন করার সময় মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে অসংখ্য, হাড়গোড় ও মাথার খুলি। ভোমরার এ স্কুলটি ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। সীমান্ত থেকে দূরত্ব ৪ কিলোমিটারের মতো। এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ সন্দেহভাজন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে এনে অধিকাংশকে জবাই করে হত্যা করা হতো। লাশ ফেলা হতো স্কুলটির পেছনের একটি ভাগাড়ে। লাশ বেশি জমে গেলে নেওয়া হতো পাশের আরেকটি ভাগাড়ে। স্কুলের পেছনের সেই ভাগাড় এখনও আছে। তবে তাতে নেই কোনো স্মৃতিফলক।
সাতক্ষীরা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন বৈকারী। ভোমরা সীমান্ত ধরে উত্তরে আট কিলোমিটার এগোলেই দেখা যাবে একাত্তরের বধ্যভূমি। এখানেই কুখ্যাত রাজাকার খালেক মওলানার বাড়ি।
বৈকারী ইউনিয়ন পরিষদের সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে এগোলেই সড়ক থামবে খালের পাড়ে। ওপারে গাবোড্ডা, কৈজুরি ঢিলছোড়া দূরত্বে। মাঝে শুধু ইছামতির শাখা, সুবর্ণরেখা বা সোনাই নদী। এ নদী থেকে ২০০ গজ দূরেই ছিলো পাকসেনাদের ক্যাম্প। খালপাড় থেকে দক্ষিণে এগোলেই যুদ্ধের সময়ের বিভীষিকার চিহ্ন চোখ এড়াবে না। ক্যাম্পের অদূরে বাঁশঝাড়ের নিচে, পাশে ছিলো কয়েকটি ভাগাড়। কয়েকটি আবার তৈরি হয় শেলের আঘাতে। বাংকারও ছিল কয়েকটি। বিওপি ক্যাম্প ঘিরে ছিলো তাদের আস্তানা। খানসেনারা মানুষ মেরে ফেলে দিতো এসব ভাগাড়ে। আর লাশের খোঁজে আসতো অসংখ্য শিয়াল। এতো বেশি শিয়াল আসতো যে নাম হয়ে যায় ‘শিয়ালের ভাগাড়’। আশপাশের বয়োঃবৃদ্ধরা এখনও চোখ বন্ধ করলে সেদিনে ফিরে যান, হয়ে পড়েন স্মৃতিকাতর।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও চিহ্ন মেলে সেই শিয়ালের ভাগাড়ের। যদিও বেশকিছু বাংকার ও শেলে-তৈরি-হওয়া গর্ত বন্ধ করে ফলানো হয়েছে ফসল। তবে বাঁশবাগানের ভেতরে গিয়ে কয়েকটি টাটকা গর্ত পাওয়া গেল। শিয়ালের গর্ত। শিয়ালের ঢোকা ও বেরুনোর টাটকা চিহ্ন মাটিতে। রাত হলেই সমস্বরে তারা ডেকে ওঠে ‘হুক্কা হুয়া…’।
যারা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন: মুক্তিযোদ্ধা মো. মুছা আমিন, মো. আব্দুর রশিদ, মো. শহীদুল ইসলাম, এ এলাকায় সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের গোলা-বারুদ বহনকারী, খাবারের যোগানদাতা মো. শহীদুল ইসলাম। (পুনঃপ্রকাশ, প্রতিবেদনটি তৈরি ২০১৬ সালে)

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version