Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: পারুলিয়া ব্রিজ উড়িয়ে দিলে পাক বাহিনী পিছু হটে

মীর খায়রুল আলম, দেবহাটা: বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী গাজী। উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের কোঁড়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে গঠিত ৯নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, পাকিস্তানিদের অত্যাচার যতই বাড়তে থাকে, ততই নিজের ভিতর মুক্তিকামী চেতনা জাগতে থাকে। আর তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে ইন্ডিয়ার টাকিতে এবং তকিপুর ট্রেনিং সেন্টারে ২ মাস প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ১ম ব্যাটালিয়ন গ্রুপ গঠন হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সুবহানকে এই গ্রুপের জেসিও করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই দলের অন্য সদস্যরা হলেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি, গোলাম হোসেন, নুরুল হক, আবু মুছা, এটিএম জামাত আলী, গোলাম রব্বানী, আব্দুল হাকিম ঢালীসহ আরো কয়েকজন।
তিনি জানান, ট্রেনিং শেষে বাড়ি ফিরেই বিভিন্ন স্থানে মাইন বসিয়ে রাতের আধারে আবারো ভারতের টাকিতে চলে যান তারা। সেখানে আবারো বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। এসময় তাদের সাথে উপজেলার নারিকেলী গ্রামের আবুল কাশেম নামে একজন প্রশিক্ষণ ঘাটিতে অবস্থান করছিল। কয়েক দিন পর আবুল কাশেম ট্রেনিং ঘাটি থেকে পালিয়ে দেশে এসে যোগ দেয় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে। বিষয়টি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আতংক বাড়তে থাকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে। এরপর ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা ও সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার ১নং ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেন তাকে ধরে আনার জন্য। তাই তারা সোর্স দিয়ে প্রতিনিয়ত আবুল কাশেমের তথ্য নিতে থাকেন। ৭১’র অগ্রহায়ণ মাসের এক রাতে আবুল কাশেম বিয়ে করে বৌ নিয়ে বাড়িতে ফেরে। খবর পেয়ে জেসিও আব্দুল সুবহানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ৩টার দিকে তার বাড়ি ঘেরাও করে। সারারাত বাড়ির চারপাশে অবস্থান করে সকাল ৬টার দিকে আবুল কাশেম ঘরের বাইরে আসলে তাকে দাঁড়াতে বলা হয়, এ সময় সে ধান ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায়। তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় তার করা একটি গুলি কাশেমের গলার নিচে বিদ্ধ হয়। এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের কাছে থাকা গামছা দিয়ে তার গলায় পেচিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন তারা। পরে, তাকে ৫-৬ জন মিলে কাধে করে নিয়ে যায় ইছামতির পাড়ে। এসময় সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার তাকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিলে গোপাল গণি এসএমজি স্টেন গান দিয়ে ওই রাজাকারকে চিরতরে খতম করে দেয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী গাজী জানান, হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকায় পিস কমিটি গঠন করে। এই কমিটির নেতারা প্রতিটি এলাকার বাড়ি থেকে একজন একজন করে লোক নিয়ে খান সেনাদের বাংকার (মাটি খুঁড়ে যুদ্ধের বিশেষ ঘর) নির্মাণ করে নিত। সারাদিনের কাজ শেষে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাদেরকে। এরপর তাদের বাড়ির পাশের টেলিফোন লাইনের খুঁটির নিচে বসিয়ে সারা রাত পাহারা দিতে হতো। সারা দিনের কষ্টের পর রাতের আধারে বাতি জ্বালিয়ে রাত পার করতে হতো সাধারণ মানুষদের। আর পিস কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা এলাকার সকল খবরা খবর পৌঁছে দিত খান সেনাদের ঘাটিতে। দেবহাটা অঞ্চলে পিস কমিটির প্রধান ছিল আব্দুল করিম মিয়া। তাদের অমানসিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখে তার (মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী গাজী) ধমনীতে মুক্তির চেতনা বাড়তে থাকে।
তিনি আরও বলেন, চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ। ধীরে ধীরে শত্রুমুক্ত হচ্ছে এক একটি এলাকা। বর্ষার সময়। ঝুম ঝুম করে বর্ষা হচ্ছে। সখিপুর-পারুলিয়া বাজারে অবস্থান নিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। মাত্র কয়েক গজ দূরে মুক্তি বাহিনী। থেমে থেমে চলছে গুলি। সতর্ক অবস্থায় উভয় বাহিনীর সদস্যরা। সেই রাতে পরিকল্পনা হল দক্ষিণ অঞ্চলের একমাত্র চলাচলের ব্রিজটি ধ্বংস করে দিলেই তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু ব্রিজ ওড়ানো এতো সহজ ব্যাপার না। কারণ পাক বাহিনী সদস্যরা ব্রিজের উপর ডিউটি করছে। আর তাই পরিকল্পনা করে রাতের আধারে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে পানিতে ভেসে ভেসে তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি, তনু গফ্ফার, আব্দুস সুবহান, ইয়াসিন মন্ডল, মোফাজ্জেল হেসেন, অমেদ আলী, ইসমাইল হোসেন, এটিএম জামাত আলীসহ কয়েকজন মিলে শক্তিশালী এক্সপ্লোজি মাইন নিয়ে হাজির হই ব্রিজের তলায়। সুকৌশলে মাইন স্থাপন করে কিছু দূরে এসেই গুলি করে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানোর মধ্যে দিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর খেজুরবাড়িয়া এলাকায় এন্ট্রি ট্রাংক মাইন ফাটিয়ে গাড়িসহ ১০-১৫ জনকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে পিছু হটতে বাধ্য হয় খান সেনারা।
মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী গাজী আরও বলেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্ত হয় দেবহাটা। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার, মেজার জলিল, লে. বেগ ও লে. মুখার্জির নেতৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধ হয় দেবহাটার কুলিয়ায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি ও হবিবুর রহমান হবি সবার সামনে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। তাদের অনুপ্রেরণায় আমরা মুক্তির নেশায় মরিয়া হয়ে জীবন বাজি রেখে সম্মুখ যুদ্ধ করি। যুদ্ধ চলাকালে খানদের একটি সেল গিয়ে লাগে আমার পিছনের যোদ্ধার গায়ে। সামান্যের জন্য আমি বেঁচে গেলেও গুরতর আহত হওয়া আমার সহযোদ্ধা সামসুর রহমান পরবর্তীতে মারা যায়। খান সেনাদের একে পর এক ছোড়া বোমের সিলিং পিছু হাটতে বাধ্য করে মুক্তি বাহিনীকে। ঐদিন দুপুরের পর পাকিস্তানি বাহিনী দেবহাটা ছেড়ে খুলনার দিকে রওনা দেয়। আমরাও তাদের পিছু হটাতে তাদের সাথে এগুতে থাকি। একদিন পর আমরা পৌঁছায় খুলনার শিরোমনিতে। সেখানে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনীদের সাথে মিলিত হয়ে এক সাথে যুদ্ধ করতে থাকি পাকিস্তানি দোসরদের বিরুদ্ধে। এসময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের অনেকেই আহত হন। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধে ছত্রভঙ্গ হতে থাকে মুক্তি বাহিনী। এমনই সময় ভারতের বিমান বাহিনী উপর থেকে বোমা মেরে ২টি পাকিস্তানি টাংক ধ্বংস করে দেয়। আর তাতেই পরাজয় ঘনিয়ে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর। পরদিন সকালে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে তাদের আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে খুলনা মুক্ত হয়।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে সকলের প্রতি আহবান জানান।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version