Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: নভেম্বরের শেষে আমার কাছে ২৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে

গাজী আসাদ:
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ। সাতক্ষীরা জেলা জাসদের সভাপতি কাজী রিয়াজ ১৯৭১ সালে ব্যবসায়িক কারণে থাকতেন খুলনার দৌলতপুরে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা শুনেই ট্রাকে করে দৌলতপুর থেকে চলে আসেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাশহদায়, নিজ বাড়িতে। সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান ভারতের আসাম প্রদেশের হাফসং ট্রেনিং ক্যাম্পে। সেখানে গ্রেনেড, রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি ও চায়নিজ রাইফেল চালনোর প্রশিক্ষণসহ ২৮ দিন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৫ আগস্ট হাকিমপুর বর্ডার দিয়ে ইঞ্জিনিয়র শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে দেশে ফেরেন। তারপর খুলনার কামরুজ্জমানের নেতৃত্বে ৮নং সেক্টরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন তালার মাগুরা ও ধানদিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলের বেতেডাঙ্গি গ্রামে ঘাটি গাড়েন তারা। গ্রামটি ছিলো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। গ্রামটিতে পাকিস্তানিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর পরিত্যক্ত ছিলো। এই ঘাটিতেই তালা মাগুরা, ধানদিয়া, পাটকেলঘাটা, খলিষখালী, তেতুলিয়াসহ আশপাশের গ্রামের যুবকদের প্রায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ। তিনি মূলত ছিলেন একজন গেরিলা প্রশিক্ষক।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে তিনি সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে বলেন, বেতেডাঙ্গি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আমাকে তালা-কলারোয়া অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর নগরঘাটার ইদু সরদারের বাড়িতে আশ্রয় নেই। তখন উদ্দেশ্য ছিলো বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প করা। নগরঘাটা ইউনিয়ন ও বল্লী ইউনিয়নের মাঝে সুমনডাঙ্গায় আমার নেতৃত্বে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতাম। কিন্তু আলবদর-রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে অক্টোবরের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। ওই গ্রামের আমতলা বিলের দুই প্রান্তের এক প্রান্তে আমরা ও অন্য প্রান্তে পাকিস্তানিরা অবস্থা করতো। আমরা এফএফ বাহিনী ও মুজিব বাহিনী একত্রিত হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধ করি। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একটানা তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়। এ সময় প্রচুর গুলি বিনিময় হয়। আমাদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসর আলবদর-রাজাকাররা পিছু হটে। তবে এই যুদ্ধে আমাকে বেদনা দেয় অন্য একটি বিষয়। আমাদের কোন মুক্তিযোদ্ধা নিহত না হলেও একজন নিরীহ কৃষক ওই দিন নিহত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ আরও বলেন, একবার কেশবপুরের সাগরদাঁড়ির চিংড়ি এলাকায় রাজাকারদের ঘাটি আক্রমণ করতে যায়। আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একটি নৌকায় করে কপোতাক্ষ নদী পাড়ি দিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অজিয়ার অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। এক সময় সে নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। তার চেচামেচি শুনে রাজাকাররা অজস্র গুলি করতে থাকে। এসময় আমরাও গুলি করতে থাকি। তখন পানিতে পড়ে যাওয়া অজিয়ারকে উদ্ধার করতে গিয়ে মাথার উপর দিয়ে অসংখ্য গুলি যেতে থাকে। এই ঘটনা মনে পড়লে এখনো আৎকে উঠি। পরে অজিয়ারকে উদ্ধার করে ভারতে পাঠিয়ে দেই। সেখানে তাকে একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তবে ওই দিন আমরা রাজাকার ঘাটিটা দখল করতে পারিনি। ফিরে আসতে হয়।
তিনি বলেন, নভেম্বরের শেষের দিকে সম্ভবত ২৮ তারিখের দিকে পাটকেলঘাটার শাকদহ ব্রিজের ওখানে আমার কাছে ২৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এটা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ জানান, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তাই যুদ্ধের পর অস্ত্র বঙ্গবন্ধুর হাতেই জমা দিতে চেয়েছিলাম। আর তাই ১৯৭২ সালের মার্চে ২১-২২ তারিখের দিকে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দেই।
তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন নিয়ে জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু এখনো সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলাম। যুদ্ধ করেছিলাম। এখন চাই সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বর্তমান প্রজন্ম প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করুক। স্বাধীনতা রক্ষা করাও একটা যুদ্ধ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version