Site icon suprovatsatkhira.com

বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যে স্বদেশচিন্তা

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে দুশো বছরব্যাপী স্বদেশ চিন্তা অব্যাহত রয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষালব্ধ চেতনা থেকে যখন জীবন জিজ্ঞাসা জাগ্রত হলো, তখন থেকেই প্রবন্ধের মাধ্যমে স্বদেশ চিন্তার সূত্রপাত। নিজের জন্মভূমির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও ভাষাগত সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, ন্যায়সংগত, সঠিক ও সটীক দৃষ্টান্তসহ বিচার বিশ্লেষণ এবং বাস্তবভিত্তিক নির্দেশনা প্রদান করাকে স্বদেশচিন্তা বলা যায়। রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্বামী-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, প্রমথ চৌধুরী, মীর মুশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, কাজী ইমদাদুল হক, লুৎফর রহমান প্রমুখ প্রবন্ধকারগণ স্বদেশচিন্তার প্রকাশ, বিকাশ ও সমৃদ্ধ করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের একটি বলিষ্ঠ শাখার নাম প্রবন্ধ। যুক্তি, তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রবন্ধের প্রাণ। বিখ্যাত প্রবন্ধকার ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, “তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক, বৈষয়িক, রাজনীতিক, অর্থনীতিক, শৈক্ষিক, সামাজিক, শাস্তিক, নৈতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক, মনস্তাত্বিক, সাহিত্যিক, সম্পাদকীয় প্রভৃতি স্বল্প পরিসরের সর্বপ্রকার ক্ষুদ্র ও কণ্ড রচনাই প্রবন্ধ।” তিনি আরো লিখেছেন, “জগত ও জীবন, শাস্ত্র ও সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি, শিল্প ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা, বিজ্ঞান ও দর্শন, নীতি ও নিয়মরীতি ও পদ্ধতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে অনুভব ও মননজড়িত, ঋদ্ধ ভাষায় অভিব্যক্ত, আবেগমিশ্রিত ও যুক্তিপূর্ণ কথার পরস্পর্য রক্ষা করে সুস্পষ্ট বর্ণনে, বক্তব্যে বা অভিমতে পরিসমাপ্ত গাঁথা বাক্মালার নাম প্রবন্ধ।” প্রবন্ধ সাহিত্যে একটা দেশের সুশিক্ষিত, মননশীল ও কল্যাণকামী মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন, রুচি-সংস্কৃতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য, ভাব-চিন্তা প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়। প্রবন্ধ সরাসরি পাঠকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তার মন, মনন ও মস্তিকে ধাক্কা দেয়। পাঠককে প্রচণ্ড ভাবে ভাবিয়ে তোলে, তাকে জীবন জিজ্ঞাসায় উদ্বুদ্ধ করে। পাঠক তখন নতুন ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে। যুক্তিবাদী, তথ্যনিষ্ঠ ও বিবেকী চিন্তায় আকৃষ্ট হয়। মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে জানবার, বুঝবার ও দেখবার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়।
প্রবন্ধকে প্রকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্ত রচ না বললে সবটা ব লা হয় না। প্রবন্ধকে তত্ত্ববহুল, তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণধর্মী হতে হয়। বলতে গেলে তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রবন্ধের প্রাণ। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট প্রবন্ধকার, সমালোচক ও নজরুল জীবনীকার ড. অরুণ কুমার বসু লিখেছেন, “সাধারণত প্রবন্ধ বলতে আমরা বুঝি জ্ঞানগর্ভ গদ্য রচনা, যার উদ্দেশ্য ১. তথ্য প্রমাণের দ্বারা কোনো কিছু প্রচার করা, ২. প্রতিষ্ঠিত করা, ৩. বিতর্কের সাহায্যে কোনো প্রতিপক্ষ বক্তব্যকে খণ্ডন করা, ৪. নতুন যুক্তির আঘাতে অভ্যস্ত কোনো বিষয়কে ধরাশায়ী করা এবং ৫. নতুন বিষয় বা সিদ্ধান্তকে উপস্থাপিত করা।” পশ্চিমবঙ্গের আরেকজন প্রবন্ধকার-সমালোচক লিখেছেন- “প্রবন্ধে প্রকৃষ্ট বন্ধন থাকতে পারে, যেমন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনায় আছে, আবার নাও থাকতে পারে, যেমন রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনায়। তবে পূর্বাপর সঙ্গতি সেখানে রক্ষিত হয়, আর সেই সঙ্গতি রচিত হয় লেখকের চিন্তন, অনুমান, সংকল্প, ভাবনা নিয়ে। আসলে প্রবন্ধে ধরা থাকে লেখকের ‘মনের জীবন’।” আমি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে কয়েকজন প্রবন্ধকারের স্বদেশচিন্তার বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। দেশ বিভাগের পর বিশেষ মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম রক্ষার জন্য। এজন্যই ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালির মাতৃভাষাকে বিকালঙ্গ করবার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। অথচ বাঙালিত্বের সংগে মুসলমানিত্বের কোনো দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। এসব দূরভিসন্ধির বিরুদ্ধে বীরের মত রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ মহাপন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকার সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। যা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।” তিনি বলেছিলেন, বাংলা ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা, উর্দু নয়।
এদেশের বিখ্যাত নাট্যকার একাত্তরের শহীদ মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এজন্যে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেলা বসেই তিনি তার ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক অমর নাটক ‘কবর’ লিখেছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় প্রতিবাদ আর কি হতে পারে? তিনি আরও লিখেছিলেন, “আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পনচূর্ণকারী, আরাকানের রাজসভার মনিময় অলংকার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।”
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃৃদ্ধ একজন যুক্তিবাদী। প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে মাতৃভাষাপ্রীতি ও স্বদেশচিন্তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভঙ্গীকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী, সাহিত্য প্রেমিক ও সঙ্গীত পিপাসু মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করতেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও যথার্থ অর্থেই একজন বিশ্বাসী মুমীন মুসলমান। তার জীবনে বাঙালিত্বে ও মুসলমানত্বে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্বে তার অগাধ আস্থা ছিল। তাই তিনি ভাষার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে সে দিন লিখেছিলেন এভাবে, “বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে।” তিনি তার দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিভাবান লেখকের মধ্যে একটি তৃতীয় নেত্র থাকে। এই নেত্র দিয়েই তিনি ভবিষ্যতকে দেখতে পান। অত্যন্ত সমাজ সচেতন প্রবন্ধকার আবুল ফজল সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে অসংখ্য স্বদেশচিন্তামূলক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ভাবতেন, রাজনীতি ক্ষেত্রে ধর্মকে নিয়ে এলে দেশের সমূহ বিপদ হতে পারে। দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তিনি লিখেছিলেন, “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ভাওতা ছাড়া কিছু না। এ ভাওতার ফলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কারণ এদের হাতে পড়ে দিন দিন ধর্ম হারাচ্ছে তার আসল রূপ। রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনায় দেশের রাজনীতিও রীতিমত ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।” একথা তিনি লিখেছিলেন পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে। তখন ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করা অত্যন্ত বিপদজনক ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি ভয়াবহ উগ্রতা, বাড়াবাড়ি ও জঙ্গীরূপ ধারণ করেছে। আবুল ফজল আরো লিখেছিলেন, “কোনো রাজনীতির সংগেই ধর্ম খাপখেতে পারে না। আধুনিক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে সিকুলার, কিন্তু ধর্মকে আধুনিক বা অনাধুনিক নামে কিছুতেই চিহ্নিত করা যায় না।” সুতরাং ধর্মের জায়গায় ধর্ম, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি থাকা উচিত। আবুল ফজলের যাবতীয় স্বদেশ চিন্তামূলক প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বর্তমানে ধর্ম ও রাজনীতি দুটি পৃথক ক্ষেত্র, দুটোর উদ্দেশ্য ভিন্ন এবং এই দুটোকে আলাদা রাখা উচিত। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।
আব্দুল হক ছিলেন বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের একজন সাহসী লেখক। তিনি স্বদেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কারমুক্ত স্বাধীন চিন্তাচর্চার একজন ধারক, বাহক ও সাধক ছিলেন। তার লিখিত ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ‘বাঙালি মুসলমান: ভূমিকা ও নিয়তি এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদ: পূর্ণঃনিরীক্ষা’ এই তিনটি প্রবন্ধ, সেকালে তুমুল বিতর্ক, আলোড়ন ও তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘বাঙালি মুসলমান যে বাঙালি, পশ্চিমাগত নয়, এই চিন্তার দ্বারা যেন সে পীড়িত হয়েছে, বাঙালি হওয়াটাকে সে যেন একটা অপরাধ বলে মনে করেছে। সে যদি নিজেকে বাঙালি মনে করতো, সগৌরবে এবং সবলে নিজেকে বাঙালি বলে ঘোষণা করতো এবং নিজের সত্ত্বা ও ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতো, তবে তার গোষ্ঠী চেতনা প্রবল হতে পারতো।’ এজন্য সে সময়ে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা সংহত হতে পারিনি। পরিণামে তখন তার অনুকরণবৃত্তি ও চৈত্তিক সংকীর্ণতা প্রবলতর হয়েছিল।
ড. আহমদ শরীফ বাংলাদেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধকার। তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই একজন বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মনে প্রাণে ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তার ধারক। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা সচেতন প্রবন্ধ পাঠকদের চেতনার দিগন্ত প্রসারিত করেছে। মনুষ্যত্বের বিকাশ, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাচর্চায় তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও শক্তিশালী প্রবন্ধকার। তিনি ছিলেন অকুতোভয় কলম সৈনিক। সমাজ সচেতনতা, ইতিহাসবোধ ও দার্শনিক চেতনা তাঁর প্রবন্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার প্রবন্ধ তাই সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও শিক্ষাগত সমস্যা ও সম্ভাবনার কথায় সমৃদ্ধ। তিনি যখন লেখেন এভাবে, “ভৌগলিক ঐক্য, ধর্মীয় অভিন্নতা, মতবাদের একতা, রাষ্ট্রিক বন্ধন ও গৌত্রিক-পরিচয় কখনো অকৃত্রিম, জাতি গড়ে তুলতে পারে না।” তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, একই ধর্মাবলম্বী হলেই যে একটা ভালো জাতি গড়ে উঠবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আবার তিনি যখন লেখেন এভাবে, “আরবী-ফারসী কিংবা উর্দুর সবটা শস্ত্রীয় নয়, সুমুসলমানের রচনাও নয়। আজো উক্ত তিন ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকরা সব মুসলিম নন। আজো আরবীভাষী লোকের শতকরা পনের জন খৃষ্টান ও ইহুদী।” তখন বুঝা যায়, আরবী শুধু মুসলমানের ভাষা নয়, খৃষ্টান-ইহুদীদেরও ভাষা। সুতরাং বাংলা ভাষা অবশ্যই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা।
বদরুদ্দীন ঊমর বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রকৃত অর্থেই একজন মার্কসবাদী লেখক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ষাট দশকে বাঙালিত্ব, সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ অনুসন্ধানে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আমরা বাঙালি না মুসলমান এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও বাকবিতচিন্তা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর লিখেছিলেন এভাবে- “বাংলাদেশের যে কোনো অংশে যারা মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাংলাদেশের আর্থিক জীবনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলার ঐতিহ্যকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে, তারাই বাঙালি।’ সুতরাং একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যে কোনো ধর্মের লোক হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান যে কেউ বাংলা ভাষী হলেই সে বাঙালি হতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো বাঁধা নেই কোনো দ্বিধা নেই, কেনো দ্বন্দ্ব নেই। কে কোন ধর্মাবলম্বী, সেটা কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। ধর্মটা যার যার, নিজের নিজের কিন্তু রাষ্ট্র সবার। বাঙালি বলে নিজেদের পরিচয় দিলে তখন হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়তো ধর্ম বিরোধিতা হতে পারতো। তিনি আরো লিখেছিলেন এভাবে, “কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয়, যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।” কোনো এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক যখন অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের ক্ষতি করতে চায়, তখন তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে।
বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) ৭ (সাত) জন বিশিষ্ট প্রবন্ধকারের প্রবন্ধসমূহে কিছুটা হলেও আমি স্বদেশচিন্তা অনুসন্ধান করেছি। দেখা গেলো, বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্বের জন্য এদেশের প্রবন্ধকারবৃন্দ জীবনকে বাজী রেখেই লেখনী ধারণ করেছিলেন। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের প্রবন্ধকার বেশ সাহসিকতার সঙ্গে কলম ধরেছিলেন। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকার আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন বলা যায়। বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম করবার জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন বাঙালি প্রবন্ধকারবৃন্দের অবদান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বাঙালিরা চিরকাল তাদের এই কার্যক্রম, এই তৎপরতা, লেখনীর মাধ্যমে এই জনমত গঠন, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version