Site icon suprovatsatkhira.com

স্মৃতি চারণ: কলারোয়ার মমতাজনগর এক নতুন বাংলাদেশ

কলারোয়ার বোয়ালিয়া আমার বহু পরিচিত একটি গ্রাম। সোনা ফলা এই গ্রামের মাঠভর্তি হলুদ সরষে ফুলের মনমাতানো নাচন। চারদিকে মৌমাছির মৌ মৌ গান। ফসলে ভরে ওঠা মাঠ। লকলক করা সবুজ সবজিতে ঠাঁসা গ্রাম। মাঠে কৃষক কাজ করছেন আপন মনে। বাড়িতে বাড়িতে হাঁস মুরগী গবাদি পশুর অভয়ারণ্য। মাঠে চরছে গরু। রাখাল বাজায় বাঁশী। গ্রামের মধ্য দিয়ে সরু পথ চলে গেছে দূরে বহুদূরে। বাড়ির আঙিনায় ছোট ছোট বাগান। নারকেল সুপারি আম কাঁঠাল গাছে ঠাঁসা। আছে বাঁশের ঝাড়। নিকটেই ভারতীয় সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া ঘেরা এই সীমান্ত একদিন মুক্তিযোদ্ধারা তছনছ করে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হঠিয়ে দিয়েছিল। এ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। সে ইতিহাস একাত্তরের। কিন্তু বোয়ালিয়া গ্রামকে আমি দেখেছি এক নতুন রূপে। মনে হয়েছে এ এক অন্য বোয়ালিয়া। অন্য এক বাংলাদেশ। নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ আমাকে সব সময় হাতছানি দেয়।
এই গ্রামেই গড়ে উঠেছে ‘মমতাজ আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’। বিস্ময়ে আমি হতবাক। কমপ্লেক্সে ঢুকতেই বামধারে চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন এই মাটিরই সন্তান মমতাজ আহমেদ। জীবনব্যাপী যে মানুষটি মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনিই মমতাজ আহমেদ। নির্লোভ, নিরহংকার, সরল, সহজ, সাদাসিদে, শ্বেত শুভ্র শশ্রুম-লীর সাথে শুভ্র বসন। হাতে তার ছাতা আর লাঠি। সেই মানুষটিই দান করে গেছেন তার সব সম্পদ। নির্মাণ করেছেন অগণিত স্কুল কলেজ মাদ্রাসা। ছিলেন শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজসেবক, জনপ্রতিনিধি। তিনি ছিলেন ১৯৫৪ এর এমএলএ, ১৯৭০ এর এমসিএ ও ১৯৭৩ এর এমপিএ। তিনি ছিলেন কবি, তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। ছিলেন একজন গায়ক, ভাবুক। মুক্তিযুদ্ধের বড় মাপের সংগঠক। বঙ্গবন্ধুর অতি ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সেই মমতাজ আহমেদের স্মৃতি তর্পনে গত বছর চতুর্থ স্মরণ সভায় যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানেই এতোসব দেখে হতবাক। এই ভূখ- এখন মমতাজনগর। এই মমতাজনগরই যেনো নতুন এক বাংলাদেশ। আমি বারবার দেখি যার মুখ। বারবার উচ্চারণ করি যে ভাষা বাংলা ভাষা। আজ ৩ নভেম্বর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্বেত বসনের মমতাজ আহমেদকে আবারও বিন¤্র শ্রদ্ধা।
মমতাজ কমপ্লেক্সে ঢুকতেই চোখে পড়া সুপারি গাছের সারি যেনো এক একজন প্রহরীর মতো সোজা দাঁড়িয়ে। তার দুই ধারে আমি দেখেছি অবিরাম বাংলার মুখ। ডানপাশে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। তারপরই তার রাজনৈতিক সহচর মমতাজ আহমেদের ম্যুরাল। সুপারি সেনাদের মধ্য দিয়ে সামনে এগুতেই ডানে বাঁয়ে রয়েছেন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পল্লী কবি জসীমউদ্দিন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, কবি বেগম সুফিয়া কামাল। তাদের এক একটি ম্যুরাল যেনো এক একটি জগত নিয়ে দ-ায়মান। এরপরই তর্জনী উচিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই বাংলাদেশের স্বপ্নই তো দেখেছে বাঙালি। তারাই তো নতুন বাংলার পথপ্রদর্শক।
মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে ঢুকেই নজর কেড়ে নেবে ৭১ এ শরণার্থীদের জীবন, সাথে রণাঙ্গন। চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধে নারী, জীবন গড়ার সাথী নারী। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি, নৌপথে মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তির লড়াইয়ে নারী, ধ্বংসের মধ্যে স্বাধীনতা, পরিবর্তনের বারতা, দেশের ডাকে সাড়া। আছে নিরাপদ আশ্রয়ের রাস্তা, মুক্তিব্রতী যোদ্ধা, তাঁবু আশ্রিত জীবন। কত প্রাণ হলো বলিদান। আছে সমাজচিত্র বৈষম্যমূলক পরিবার। কমপ্লেক্সে দেখা মিলবে, ‘আমাদের পক্ষে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ’, নদী বক্ষে স্কুল, অনিশ্চিত আশ্রয়, দুর্যোগে মানুষ, সোনা ফলানো সৈনিক, মুক্তিসেনা, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। কমপ্লেক্সে আমি দেখেছি একুশ শতকের নারী জাগরণ, ঘরে ঘরে রোগ প্রতিরোধ, সন্তানের ভবিষ্যত, মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ। যুদ্ধ জয়ে যুব জাগরণ, যুদ্ধজয়ে অস্ত্র সম্ভার। ম্যুরালে সাজানো গোছানো এসব দৃশ্য আমাকে ডাক দিয়েছে। জাতির গণসংগ্রামে তারা আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তারাই তো বলেছেন নতুন এ বাংলা হবে কৃষকের, শ্রমিকের, কামারের। কুমোরের, মুটে আর মজুরের, এক কথায় সব মানুষের।
বিন্যস্ত দুর্বাদলে নরম সজ্জায় সজ্জিত বোয়ালিয়া গ্রাম মমতাজনগর হয়ে ওঠায় এখানে আসছেন সব শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা বুকভরে নিচ্ছেন নির্মল বায়ু। প্রাণভরে দেখছেন এসব ম্যুরাল। মুখে উচ্চারণ করছেন এখানেই তো বাংলার সূর্য সেনার দল, ভয় কি তবে এগিয়ে চল। এখানে মেলেছে আঁখি, বরষায় ভিজিছে পাখি, ডাকিছে কোকিল, হেলিছে তমাল, সবুজ তরুতল। বৃক্ষ সেনারা বসালো পাহারা, রক্তের অক্ষরে লিখেছে, একটি নাম বাংলাদেশ।
লেক ঘিরে গড়ে ওঠা মমতাজনগরের পরিচালকরা বললেন, মমতাজ আহমেদ ছিলেন সততা, সত্যবাদীতা, কৃচ্ছতাসাধনকারী অহংকারহীন একটি মানুষ। অসাম্প্রদায়িক, মানবসেবক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে ডেকেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নিকটজন হিসাবে এক সাথে রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় নেমেছেন। তার সঙ্গী একটি ছাতি একটি লাঠি একটি টুপি। শুভ্র বসনে মমতাজ আহমেদ বারবার শুভ্রতার পরিচয় দিয়েছেন।
এই মমতাজনগরে সংবর্ধিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাতক্ষীরা-২ আসনের সাংসদ মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, কবি নির্মলেন্দু গুন, ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান ও সাহিত্যিক শেখ নজরুল। আয়োজকরা তাদের হাতে তুলে দেন মমতাজ কমপ্লেক্সের ক্রেস্ট।
মমতাজ আহমেদের জ্যোতির্ময় দ্যুতিতে আলোকিত বোয়ালিয়া গ্রাম থেকে সারাদেশ। বোয়ালিয়ার সরষে ফুলের সৌরভ, নবান্নের ঘ্রাণ, ঘাস ফসলের সবুজ হাতছানি, বিল ঝিলের শাপলার ডাক, খেজুর গুড়ের অমৃতস্বাদ, ভরা ক্ষেতে সোনালী ধানের ঢেউ, বটবৃক্ষের বিন্যস্ত আঁচল, মুক্তিযুদ্ধের নতুন বাংলাদেশকে আরও প্রাণময় করে তুলেছে। এতো এক নতুন বাংলাদেশ। লেখক: সাতক্ষীরা করেসপনডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version