Site icon suprovatsatkhira.com

উন্মোচিত হচ্ছে দেবহাটার শিশু তমা হত্যা রহস্য!

মীর খায়রুল আলম ও এমএ মামুন, দেবহাটা: ধীরে ধীরে পর্দা খুলে বেরিয়ে আসছে দেবহাটার শিশু ফারিহা সুলতানা তমা হত্যার রহস্য। ঘটনার অনুসন্ধানে প্রশ্ন উঠেছে, এই মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তারাই কি প্রকৃত অপরাধী? না কি অন্যকে ফাঁসাতে এই নাটক সাজানো হয়েছে। তা নিয়ে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
এদিকে বাদি পক্ষ আরজিতে যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তার সাথে ঘটনার অনেক কিছুরই মিল নেই বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই।
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পূর্বের রাজনৈতিক জের ধরে গ্রুপিংকে কাজে লাগিয়ে অপরপক্ষকে ঘায়েল করতে এমন নাটক সাজানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। আর এরই সূত্র ধরে গত ২০ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় শিশু ফারিয়া সুলতানা তমাকে-দাবি এজারের উল্লিখিত আসামিদের। এর আগে গত ২৪ জুলাই একই পরিবারে সৎ মা কর্তৃক পুত্র শিশুকে হত্যা চেষ্টার ঘটনাও ঘটে। আর তাই শিশু তমা হত্যার বিষয়টি ঐ পরিবারের নতুন ঘটনা নয় বলেও প্রাপ্ত তথ্যে উঠে এসেছে।
এদিকে গোপন সূত্রে জানা গেছে, যে রাতে হত্যা হয় তমা ঐদিন বিকালে রিপনের প্রতিপক্ষ মোকছেদের ভাইপো আলিম নিহতের পিতা ও একাধিক ব্যক্তির সাথে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রেখে চলছিল। তাছাড়া আলিমসহ অন্যদের মোবাইল ফোনের কল লিস্টে সন্দেহের দাঁনা বাধে। পুলিশের দেওয়া মোবাইল কল লিস্টের সূত্র ধরে দেখা গেছে, ঘটনার দিন (২০ সেপ্টেম্বর) নিহতের পিতা ও ফরহাদের সাথে সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে কথা হয় ইটভাটার কর্মচারী হাসানের।
সূত্র জানায়, তখন ফরহাদের মোবাইল লোকেশন বহেরার এমাদুল মাস্টারের বাড়ির সামনে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ মহাসড়কে। এরপর থেকে বন্ধ হয় ফরহাদের মোবাইল ছিল। রাত ১০ টা ১৭ মিনিটে আলিপুর ফিলিং স্টেশন এলাকায় ফোনটি পুনরায় চালু হয়। সেখান থেকে ফরহাদকে আলিম আবারো ফোন করে।
ফরহাদের ফোন পৌণে ৪ ঘণ্টা বন্ধকালে ৪ বার কথা হয় চৌকিদার মঞ্জুরুলের সাথে আলিমের। এমনকি ঐ সময় মঞ্জুরুলের ফোন লোকেশন ফরহাদের পাশে দেখাতে থাকে। সন্ধ্যা ৬ টা ৫৭ মিনিট ও ৮ টা ৪৪ মিনিটে কথা আলিমের চাচা কওসারের সাথে। আলিম তার চাচাতো ভাইপো আল-আমিনকে ৭ টা ৪৫ ও রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে কল করে। পর্যাক্রমে সে রাত ৮ টা ৬ মিনিটে কল দেয় চাচাতো চাচা শাহাদাতের কাছে। এরপর রাত ৮ টা ১৬, ৮ টা ৪৬, ৯ টা ১৫ মিনিটে কথা বলে ফুফাতো ভাই গোলাম হোসেনের সাথে। এছাড়া আলিম ৬ টা ৩৫, ৬ টা ২৯ মিনিটে কথা বলে স্থানীয় মেম্বর রব্বানির ইট ভাটার কর্মচারী হাসানের সাথে। তবে মোখছেদের ভাইপো আলিম বিকাল থেকে পারুলিয়ার সেকাই ঈদগাহ এলাকায় বসে একাধিক ব্যক্তি সাথে যোগাযোগ রেখে চলছিল। পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারীরা দীর্ঘ সময় অবস্থান করছিল খাসখামার আক্তারুলের দোকানের পার্শবর্তী স্থানে। আর সেখান থেকে শিশু হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ঘটানার দিন থেকে অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি মোখছেদের বাড়িতে ভিকটিম ও তার পরিবার অবস্থান করছে। একই সাথে মোখছেদের পুত্র তুহিন হোসেন শুক্রবার বিকাল থেকে এলাকা ছেড়ে আত্নগোপন করে আছে। তাছাড়া সন্দেহের তালিকায় উঠে আসা ব্যক্তি পুষ্পকাটি গ্রামের আফসার উদ্দীনের ছেলে আব্দুল আলিম, মঞ্জুরের ছেলে গোলাম, আব্দুল জলিল গাজীর ছেলে শাহাদাত, শহিদুল গাজীর পুত্র হাসান (হাসা)সহ অন্যরা নিজেদের লোকালয় থেকে গোপনে অবস্থান করছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি একটি অস্ত্র মামলায় পুষ্পকাটি গ্রামের কেয়ামদ্দীন গাজীর পুত্র মোকছেদ আলী পুলিশের হাতে আটক হয়। আর এই মামলায় স্বাক্ষী করা হয় পুষ্পকাটি গ্রামের লিয়াকাত আলীর পুত্র রিপন ও শওকাত সরদারের পুত্র নাজমুল হুদাকে। ঘটনাটি নিয়ে মোকছেদ গ্রুপের সাথে রিপন ও নাজমুল হুদার বিরোধ চলে আসছিল। তারই সূত্র ধরে রিপন ও নাজমুল হুদাকে ফাঁসাতে প্রতিবেশী ফরহাদের ৪ বছরের শিশু কন্যা ফারিয়া সুলতানা তমাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে প্রতিবেশীরা।
এদিকে প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায়, ২১ সেপ্টেম্বর সকালে উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের পুষ্পকাটি গ্রামের পুকুর থেকে ভাসমান অবস্থায় ফারিয়া সুলতানা তমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার সঠিক তদন্ত সম্পন্ন করতে ঐদিন শিশুর পিতা ফরহাদ হোসেন, দাদা আবু খালেক ও ফরহাদ হোসেনের মামা আকরাম সরদারের পুত্র রজব আলী ও আকবর, বন্ধু আফসারের পুত্র আব্দুল আলিমকে থানায় নিয়ে যায়। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ২২ সেপ্টেম্বর শিশুর মা সার্জিনা বেগম ৬ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করে। পরে ২৩ তারিখে মামলাটি নথিভূক্ত হয়। আর এই মামলার ঘটনার সাথে মোবাইল ফোনের লোকেশনের গরমিল থাকায় জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
শিশুর মা সার্জিনা বেগম জানান, তার স্বামী ফরহাদ হোসেন কন্যা ফারিহা সুলতানাকে নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে পার্শবর্তী দোকানে যায়। দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার স্বামীকে জিয়ারুল ডেকে কথা বলতে বলতে রজিবুল সরদারের পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় ৩০ মিনিট তারা অবস্থান করে। এরপর ওৎ পেতে থাকা এজাহারের আসামিরা ভিকটিমের মাথায় আঘাত করে। এতে সে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গেঞ্জি দিয়ে তার স্বামী ফরহাদ হোসেনের মুখ বেঁধে মুখে বাশের পাতা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য আসামিরা কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর মোখছেদের ভাইপো আলিম তার বাড়িতে গিয়ে খবর দিলে তারা লোকজন নিয়ে সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিটে ফরহাদকে উদ্ধার করে বলে জানায়। কিন্তু রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফরহাদকে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। তবে মোবাইল ফোনের কল লিস্ট ও মামলার বিবরণ অনুযায়ী প্রায় পৌনে ৪ ঘন্টা সময়ে ফরহাদের ব্যবহৃত নাম্বর থেকে কাউকে কল দেওয়া কিংবা কেউই তাকে কল করেনি। তাহলে ফরহাদ আহতবস্থায় মোখছেদের ভাইপো আলিমকে কিভাবে সে কল করে ঘটনাটি জানায়? এছাড়া কল তালিকার সময় অনুযায়ী ফরহাদ যদি রাত ১০ টা ১৭ মিনিটে আলিপুর ফিলিং স্টেশনে অবস্থান করে তাহলে তার উপর হামলা হল কোন সময়? আর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হামলা হলে রাত সাড়ে ১১টার পরে কেনো সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ এই সময় তাহেল ফরহাদ করছিল কি? এমন প্রশ্ন স্থানীয়দের মাঝে।
এদিকে অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, ফরহাদ হোসেন তার মামার বাড়িতে বসবাস করত। কিন্তু ঘটনার দিন থেকে সে মোখছেদের বাড়িতে অবস্থান করছে। আবার মোখছেদের পুত্র তুহিন কেনো পরদিন থেকে এলাকা ছাড়া। যে কারণে সন্দের তীর ফরহাদ ও আলিম বাহিনীর দিকে।
এবিষয়ে ফরহাদের মামা আকবর আলী জানান, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১১ টার দিকে আমার মা তাদেরকে এসে খবর দেয়। এসময় লাইট নিয়ে ফরহাদের স্ত্রী সার্জিনাকে নিয়ে বাঁশবাগান ও পুকুরের পাড়ে খোজাখুঁজি করি। কিছু সময় পর একটি মাইক্রে এসে ফরহাদকে নিয়ে যায়। পরদিন খোজাখুঁজির পর রজিবুল সরদারের পুকুরে লাশটি ভাসমান অবস্থায় ভাসতে দেখে আমাদের খবর দেয়। পরে আমাদের থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
ভিকটিম ও কন্যার পিতা ফরহাদ হোসেন জানান, আমি আর রিপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। আমাদের সাথে তার পারিবারিক কোন শত্রুতা নেই। তবে আমারকে বার বার যুবলীগের রাজনীতি করার জন্য ডাকে। আমি তার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় সেই জন্য তার সাথে মনোমালিন্য। তবে, ঘটনার দিন মাগরিবের পরে আমি আমার কন্যাকে নিয়ে বাড়ির পাশে এবাদুলের দোকানে খাবার কিনতে যাই। দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাঁশ বাগানের সামনে পৌঁছানো মাত্রই ৭-৮ জন লোক এসে আমার মাথায় বাড়ি মারলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন তারা আমার কন্যাকে নিয়ে চলে যায়। আমার জ্ঞান ফিরলে আমি আমার বন্ধু মোকছেদের ভাইপো আলিমের কাছে ফোন করি। সে এসে আমাকে উদ্ধার করে মোকছেদের ভাই কওছারের বাড়িতে নিয়ে যায়। ঐ রাতেই আমাকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে আহত ফরহাদের গায়ে বা মাথায় কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না বলে জানায় পুলিশ। সে নিজের বাড়ি ছেড়ে কেনো মোকছেদের বাড়িতে অবস্থান করছে জানতে চাইলে তিনি মামার বাড়িতে নিরাপত্তাহীনতার দাবি করেন। সে কারণে তিনি মোখছেদের বাড়িতে আছেন।
এদিকে, মোখছেদের ভাইপো আলিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অনেক সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছি। আমি কোন সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে পারব না। সাংবাদিকদের সাথে আমার কোন কথা নেই। এসময় ঘটনার দিন বিকাল থেকে একাধিক ব্যক্তি সাথে কেনো ধারাবাহিক যোগাযোগ করে রেখে চলছিল তা জানতে চাইলে কোন উত্তর মেলেনি তার থেকে। তিনি কোথায় আছেন জানতে চাইলে বাইরে আছেন বলে জানান।
নিহত শিশুর মায়ের দায়ের করা এজেহারভূক্ত শাহিনুজ্জামান রিপনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে এ মামলায় মিথ্যাভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। ফরহাদ আমার ফুফাতো ভাই। আমি কেনো তার শিশুকে মারতে যাব। বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাদের আত্নীয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে আমাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমি বিষয়টির সঠিক তদন্তপূর্বক আসামিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
দেবহাটা থানার এসআই ও মামলার তদন্ত অফিসার মামুনুর রহমান জানান, ২৩ সেপ্টেম্বর দেবহাটা থানায় ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী সার্জিনা বাদি হয়ে ৬ জনকে আসামি করে মামলা করে। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে কর্তৃপক্ষ মামলাটি তদন্তের ভার সাতক্ষীরা সিআইডিতে প্রেরণ করে।
সাতক্ষীরা সিআইডি অফিসের তদন্ত অফিসার জাকির হোসেন জানান, মামলাটি আমরা তদন্ত ভার নেওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
ঘটনাটি নিয়ে এলাকাবাসীর ধারণা নিহত শিশুর পিতা ফরহাদ হোসেন, কথিত উদ্ধারকারী আব্দুল আলিমসহ আটককারীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লু নিয়ে এগুলে বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য। আর তাই, এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

 

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version