Site icon suprovatsatkhira.com

সাতক্ষীরা-৪: ফাঁকা মাঠে বিভক্ত আ’লীগ, ইমেজ সংকটে জাপা প্রার্থী, সুযোগের অপেক্ষায় বিরোধীরা

এস.এম নাহিদ হাসান: সাতক্ষীরা-৪ আসন (জাতীয় সংসদের ১০৮)। জেলার শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনে ভোটার সংখ্যা তিন লক্ষ ৯৩ হাজার ৪৭৯। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের একাধিক প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাই আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও এই আসনে প্রত্যেক দলের একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী নিজ নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় ভোটের মাঠে সরব রয়েছেন।

তবে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল যেমন নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, ঠিক তেমনি মাঠে নামতে না পারলেও বিরোধীরা সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীও রয়েছেন ইমেজ সংকটে।

পূর্বাপর নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তৎকালীন খুলনা-১১ আসনে (শ্যামনগর) আওয়ামী লীগের মো. মোহাসীন, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে পুনর্নির্ধারিত খুলনা-১২ আসনে বিএনপির ডা. আফতাবুজ্জামান, ১৯৮৬ সালে সাতক্ষীরা-৫ আসনে জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, ১৯৮৮ সালে পুনরায় জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, ১৯৯১ সালে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির অধ্যক্ষ জিএম আব্দুল হক, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ কে ফজলুল হক, ২০০১ সালে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম, একই সালে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে (দেবহাটা-কালিগঞ্জ) কাজী আলাউদ্দিন, ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম রেজা এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স ম জগলুল হায়দার এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৩ থেকে ২০১৮ পেরিয়েছে দীর্ঘ সময়। এখন সরকারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বিগত দশ বছর টানা ক্ষমতায় থেকেছে দলটি। উন্নয়নও কম হয়নি। কিন্তু দল গোছাতে কতটুকু সক্ষম হয়েছে স্থানীয় নেতৃত্ব- তা নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীরা এখনো সন্দিহান।

বেশ কিছুদিন ধরে এক মঞ্চে উঠছেন না এখানকার (শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ) উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক। সর্বশেষ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের দিনও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স ম জগলুল হায়দার এমপি ও সাধারণ সম্পাদক এসএম আতাউল হক দোলন নিজ নিজ কর্মী সমর্থকদের নিয়ে পৃথক মিছিল-সমাবেশ করেছেন।

শুধু তাই নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দল শারদীয় দুর্গাউৎসবের বিজয়ায় প্রতিমা বিসর্জনের সময় স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স ম জগলুল হায়দারের দিকে জুতা প্রদর্শন, সাংসদের গানম্যান কর্তৃক প্রতিপক্ষের দিকে বন্দুক তাক করা ও প্রতিপক্ষ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিউল আযম লেলিন কর্তৃক ফাকা গুলি পর্যন্ত গড়িয়েছে। এছাড়া মিছিল-সমাবেশ এমনকি মিডিয়াতে একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন তারা।

একই অবস্থায় কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগেও। কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক দীর্ঘদিন নিজেদের মুখ দেখেন না। তাদের কারণে বিভক্ত দলীয় নেতা-কর্মীরাও।

সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জ, আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের অন্তত ছয়জন প্রার্থী কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় সভা-সমাবেশ-উঠান বৈঠক-মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও সরকারের উন্নয়ন সম্বলিত লিফলেট প্রচারের মাধ্যমে গণসংযোগ করছেন।

অপরদিকে, সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও মাঠে নামতে না দেওয়ার অভিযোগ করছেন বিএনপিসহ তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের শরীকরা।

তাদের অভিযোগ, নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। গায়েবি মামলা দিয়ে তাদের ঘরছাড়া করা হয়েছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেও নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। বসতে দিচ্ছে না চায়ের দোকানেও।

দলীয় সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স ম জগলুল হায়দার আবারও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় গণসংযোগে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে বেশির ভাগ সময়ই তিনি নির্বাচনী এলাকায় কাটিয়েছেন। এছাড়া অসহায় দুস্থ মানুষদের পাশে থাকতে তার প্রচেষ্টার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা সময় আলোচিত হয়েছে।

একইভাবে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় গণসংযোগ করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল হক দোলন। সাবেক এমপি একে ফজলুল হকের ছেলে দোলনও বিগত পাঁচ বছরে নেতা-কর্মীদের পাশে থেকেছেন, গণসংযোগে কাটাচ্ছেন ব্যস্ত সময়।

দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় গণসংযোগ করছেন কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈদ মেহেদী। আওয়ামী লীগের এই তরুণ নেতা ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপির সহিংসতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে শ্যামনগর-কালিগঞ্জের নেতা-কর্মীদের মনে স্থান করে নেন। এছাড়া এলাকায় সরকার ঘোষিত ভিশন ২০২১ ও এসডিজি বাস্তবায়নেও রাখছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

সাতক্ষীরা-৪ আসনে দলীয় মনোনয়নের আসায় গণসংযোগ করছেন শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিউল আযম লেলিন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাসুদা খানম মেধা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আতাউর রহমান।

মাঠে নামতে না পারলেও সাতক্ষীরা-৪ আসনে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় সাংগঠনিক তৎপরতা ও নেতা-কর্মীদের নাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির জতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন। ২০০১ সালে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ (দেবহাটা-কালিগঞ্জ) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার উন্নয়নে কৃত কর্মকা- তুলে ধরে তিনি এলাকাবাসীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন।

একইভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন ২০ দলীয় জোটের শরীক, সদ্য নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম। ২০০১ সালে তিনি তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এবারও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে চান। যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হয়, তবুও তিনি প্রার্থী হবেন।

এদিকে, সাতক্ষীরা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশায় কাজ করছেন দলটির কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার মোড়ল। যদিও তা ব্যানার পোস্টারেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। জাতীয় পার্টিতে যোগদানের পর এ পর্যন্ত তিনি একটি সভাও করতে পারেননি এলাকায়।

এছাড়া এলাকায় ইমেজ সংকটে থাকা আব্দুস সাত্তার মোড়লের বিরুদ্ধে সুন্দরবনের হরিণ শিকারের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তিনি চিহ্নিত হরিণ শিকারী হিসেবে পরিচিত।

এদিকে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট করতে চান জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত প্রেসিডিয়াম সদস্য এইচএম গোলাম রেজা। তিনি বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) বিকালে বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন।

নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশা প্রসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি স ম জগলুল হায়দার বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে সর্বাত্মকভাবে এলাকাবাসীর সাথে থেকেছি। যথাসাধ্য উন্নয়ন করেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন প্রচারে ও মানুষকে ভালবাসতে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। আমি আশাবাদী দল আমাকে আবারও মনোনয়ন দেবে।

কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈদ মেহেদী বলেন, ১৯৯২ সালে কালিগঞ্জ কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯৪ সালে কালিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯৮ সালে কালিগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, ২০১৩ সালে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ এর কালিগঞ্জের আহবায়ক ও ২০১৫ সালে কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দলের জন্য কাজ করছি। ২০০৬ সালে শ্যামনগর-কালিগঞ্জ আসনে ২১ হাজার ভুয়া ভোটার সনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছি। ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপির সহিংসতায় কালিগঞ্জ-শ্যামনগর অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তখন সাহসিকতার সাথে জীবনবাজি রেখে মাঠে নেমেছি। আমাকে কয়েকবার হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও প্রতিরোধ গড়ে তুলে শ্যামনগর-কালিগঞ্জবাসীকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। তারপর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে মনোনিবেশ করেছি। নেত্রী ঘোষিত ভিশন ২০২১ ও এসডিজি বাস্তবায়নে কাজ করছি। দল আমার বিষয়টি দেখবে আশা করি।

শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস. এম আতাউল হক দোলন বলেন, আমি ১৯৮৯-১৯৯১ সাল পর্যন্ত শ্যামনগর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, ১৯৯৮-২০০৩ সাল পর্যন্ত শ্যামনগর উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি, ২০০৩-২০১৪ সাল পর্যন্ত শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামীলীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সেই থেকেই এলাকায় জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। আপদে-বিপদে নেতা-কর্মীদের পাশে থেকেছি। দল আমার উপর আস্থা রাখবে বলে বিশ^াস রাখি।

বিএনপির জাতীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমাদের তো মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে। তারপরও বলি, প্রতীক পেলে সব ভেসে যাবে। আর এই বিশ^াস আমার আছে যে দল থেকে মনোনয়ন আমাকেই দেওয়া হবে।
সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তারপরও দলের সমর্থন নিয়ে আমি স্বতন্ত্র হলে নির্বাচনে অংশ নেব। যদিও আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে আসতে দিচ্ছে না সরকার।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার মোড়ল বলেন, আশা করছি দল থেকে আমাকে মনোনয়ন দেবে। মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলে এলাকার উন্নয়নে সবধরনের কাজ করবো।

সদ্য বিকল্পধারায় যোগ দেওয়া সাবেক এমপি এইচএম গোলাম রেজা বলেন, বিকল্প ধারায় যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে তিনি নতুন যাত্রা শুরু করেছেন। বিকল্পধারার হয়েই সাতক্ষীরা-৪ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে চান তিনি।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version