Site icon suprovatsatkhira.com

রণাঙ্গনের গল্প: কৈখালী যুদ্ধে রকেট লাঞ্চার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দেই

স.ম ওসমান গনী সোহাগ: বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বাইন। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কলবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
১৯৭১ সালে গাবুরা জিএলএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসএসসিতে অধ্যয়নকালে ২২ বছর বয়সে দেশমাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিরাপদ বাইন।
যুদ্ধ করেছেন ৯নং সেক্টরের সি কোম্পানিতে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, লোকমুখে, রেডিওতে এবং ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশ থেকে শুনতাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি সবাইকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার তাগিদ দিচ্ছেন। এটা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়।
তিনি বলেন, আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তানের খান সেনারা ছাত্রদের উপর জুলুম অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে। তখন আমি নিজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। আরো খবর পেলাম ভারতে নাকি ছাত্ররা সমবেত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তখন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যাই। ভারতে চলে যাওয়ার কিছুদিন পর জানতে পারি, আমার মা এবং আমার দাদাও প্রাণে বাঁচার জন্য মোল্লার হাটে পালিয়ে এসেছে। আমি জানতে পেরে আমার মা ও দাদার সাথে দেখা করি। পরবর্তীতে আমি মুক্তিযুদ্ধ সহায়তা কেন্দ্র তুর্কিপুর, বসিরহাটে যোগ দেই। ওই ক্যাম্পে দুই দিন থাকার পর ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ট্রাক এসে আমাদের সিংহম জেলার বিহার চাকুলা বিমানবন্দরে ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরেই নিয়ে যায় ভারতের নদীয়া জেলার কলোনী হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে আসে ভারতের পার হাকিমপুর এবং সাতক্ষীরা সদরের পশ্চিম পার্শ্বে ভাদলি নামক একটি স্থানে। তারপর শুরু হয় আমাদের যুদ্ধ। পরে ভারতের ইটিন্ডা ও বাকুন্ডা হয়ে আমরা আসি ভারতের শমসেরনগর সীমান্ত সংলগ্ন শ্যামনগরের কৈখালীতে। সেখানে ক্যাপ্টেন বেগের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করতে লাগলাম। খানসেনারা আমাদের এই আস্তানাটি গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন নৌপথে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালাত। কিন্তু ক্যাপ্টেন বেগের নেতৃত্বে আমরা রকেট লাঞ্চার দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পর পাকিস্তানিরা পিছু হটে। তারপর এখানে একটি ডিফেন্স ব্যুরো নির্মাণ করে আমরা যুদ্ধ করতে করতে লাগলাম। সেখান থেকে আমাদেরকে বরিশাল সদরে নেওয়া হয়। সেখানে ওয়াপদা কলোনী বান্দ রোডে ক্যাপ্টেন মাহফুজ বেগ, সুবেদার বাশার চৌধুরি, লেফটেন্যান্ট মইনুল হোসেন, লেফটেন্যান্ট তোফাজ্জেল, হাবিলদার মেজর আবদুর রব, লেফটেন্যান্ট আফজালের নেতৃত্বে খানসেনাদের আত্মসমর্পণ করানো হয়। তার কিছুদিন পরে আমরা ঝালকাঠি, চামটা, মীরকাটি, বাও খালি, কাউখালী, স্বরূপকাঠি, নবগ্রাম থেকে নদীপথে আড়িয়াল খাঁ নদীর পূর্ব পাশে মুলাদী থানায় অপারেশন করি। সেখান থেকে নদী পথে চাঁদপুর শহর থেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবেশ করে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছায়। সদরঘাটে পৌঁছানোর পর ঢাকা এলিফ্যান্ট রোডে পিজি হসপিটালের পূর্বপাশে ডাইরেক্ট ফিজিক্যাল এডুকেশন ইউনিভার্সিটিতে মিলিশিয়া ক্যাম্পে ইন্ডিয়ান আর্মিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মেজর চেপরা সিং এর অধীনে মিলিশিয়া ট্রেনিং এ যোগ দেই এবং মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে ১২টির মধ্যে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
তিনটি বাকি থাকতে এম এ জি ওসমানী এসে ইন্ডিয়ান আর্মিদের ফাইট করার নির্দেশ দিলে তারা ট্যাংক ও গোলাবারুদ দিয়ে তাদেরকে গুড়িয়ে দেয়, এতে আমরা জয়লাভ করি।
পরবর্তীতে ধানমন্ডি ১৯ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি এবং সেখানে আমরা অস্ত্র জমা দেই। দুদিন ওখানে থাকার পরে ক্রমান্বয়ে আমরা নিজেদের এলাকায় ফিরতে থাকি।
কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান- এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুদ্ধ করেছিলাম দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্ম-মতের ঊর্ধ্বে থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য। সর্বোপরি দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি লক্ষ্য রেখে সম্প্রীতির মেলবন্ধনে বসবাস করতে চাই। দেখতে চাই সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version