নাজমুল হক, পাটকেলঘাটা: পাটকেলঘাটার সেই পুরানো বাজার ও কপোতাক্ষের ঐতিহ্য এখন শুধুই স্মৃতি। পাটকেলঘাটা বাজারটি সাতক্ষীরা জেলার একটি অন্যতম বৃহৎ বাজার। অনেক ইতিহাস এতিহ্যঘেরা বাজারটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া কিছুটা স্পর্শ করলেও হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত এ বাজার সপ্তদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। মূলত: তখন পারকুমিরা, পুটিয়াখালী, চৌগাছা গ্রাম নিয়ে পাটকেলঘাটা গঠিত হয়েছিল। ২০০৩ সালে ৩০ মার্চ পাটকেলঘাটার ঐতিহাসিক ফুটবল মাঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পাটকেলঘাটাকে থানা ঘোষণার পর ২০০৫ সালে ১৫ জানুয়ারি ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ থানার কার্যক্রম শুরু হয়। থানা হওয়ার পর কিছু বিল্ডিং বাড়ি নির্মাণ ও জমির দাম বৃদ্ধি ছাড়া দৃশ্যমান তেমন কিছু হয়নি এখনো। তবে হারিয়ে যেতে বসেছে এ বাজারের অনেক পুরানো ঐতিহ্য।
এক সময় পাটকেলঘাটা বাজারের গরুর হাট, হাঁস-মুরগির হাট, চামড়ার হাট, পুরাতন কাপড়ের হাট, গুড়ের হাট, হলুদের হাট, কাঁচা মালের হাট, মাদুরের হাট, ঝুড়ি-ডালার হাট, পান-সুপারির হাট, ধান-চালের হাট, পাটের হাট, নারকেল হাট, চারার হাট, কলাই-মশুরের হাট, গোল পাতার হাটসহ অনেক কিছুর জন্যই বিখ্যাত ছিল হাটটি। কালের আবর্তে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে বাজারের এ সকল পুরানো ঐতিহ্য।
পাটকেলঘাটার নামকরণের কারণ হিসাবে যতদূর জানা যায় পাটকেলঘাটা থেকে নদী পথে প্রচুর পাট কোলকাতায় নেয়া হতো। তাই স্থানটির নাম পাটের ঘাট থেকে পাটকেলঘাটার উৎপত্তি। অন্য আরেকটি ধারণা হতে জানা যায়, পূরাকালে এতদাঞ্চলের গৃহস্থরা বাড়ি ঘর-দোর নির্মাণের জন্য নদী পথে ইট এনে এখানকার কোন একটি ঘাটে নামাতো। ইট-পাটকেল শব্দ থেকে পাটকেলঘাটা নামটি এসেছে।
এ বাজার যখন প্রথম গড়ে উঠেছিল তখন জায়গাটি ছিল বন-জঙ্গলে ঢাকা। পাটকেলঘাটার শতবর্ষ পুরাণো ডাকবাংলোর সামনে ছিল খেয়াঘাট। এই খেয়ঘাট থেকে পশ্চিম দিকে সাতক্ষীরা অভিমুখে সরু রাস্তাটি ছিল বাজারের প্রধান সড়ক। ব্রিটিশ আমল থেকে এই কপোতাক্ষ নদী পথে পাটকেলঘাটা থেকে কোলকাতার ব্যবসা বাণিজ্য চলত। তখন কপোতাক্ষের ছিল ভরা যৌবন, প্রশস্ত ও উন্মত্ত। মাইকেলের এই কপোতাক্ষ ঘিরে রচিত হয়েছে কতো কবিতা, গান, গল্প, ছড়া, ইতিহাস। নদীতে চলত সওদাগরী নৌকা, স্টিমার। চলত পালতোলা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, গহনা, মাছ ধরা নৌকা, টাবুরে নৌকা, গোলের নৌকা। সকাল হতে গভীর রাত পর্যন্ত শোনা যেত বাহরী পাল তোলা, সওদাগরী নৌকার মাঝিদের সারি ও ভাটিয়ালি গান, আর দাড়ের ছপ ছপ শব্দ। নদীতে দেখা যেত হাঙ্গর, কুমির, শুশুক বা সামুদ্রিক ডলফিন ইত্যাদি। নদীর দু’কূলে ছিল কাঁশবন, নলখাগড়া, গোলপাতার ঝোপ ঝাঁড় ও বন্য শুকুর, চিতা বাঘ। বিয়ে সাদীর জন্য দূর-দূরান্তের যানবাহন হিসাবে ব্যবহৃত হতো বাহারি রঙে সাজানো টাবুরে নৌকা। নদী পথে পাটকেলঘাটা হতে তালা, পাইকগাছা, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম সর্বোপরি কলকাতায় যেত যাত্রীরা। এখান থেকে খেজুরের গুড়, হলুদ, ধান-চাল, কলাই-মশুরি, তরিতরকারী, পান-সুপারি, মিষ্টি আলু, পাট ইত্যাদি গুড় হাটা ঘাট সংলগ্ন থেকে নৌকায় বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাত। নদীতে জেলেরা জাল পেতে ইলিশ, তপস্বী, ভোলা, চেলা, টেংরা, খরখুলো, আমাদী, বেলে, বাশপাতা, চিংড়ী, মলাসহ বিভিন্ন প্রকার মাছ ধরতো।
পাটকেলঘাটা ডাকবাংলো ও ছিদ্দিকিয়া মাদ্রাসার পূর্ব পাশে অবস্থিত পাটকেলঘাটা খেয়াঘাটের বিপরীতে ওপারে ছিল কুমিরা খেয়াঘাট। ২জন খেয়া পার হতে লাগত মাত্র চার আনা। কুমিরা খেয়াঘাটের পাশে সুন্দরবন থেকে বেয়ে আসা সারি সারি গোলপাতা বোঝাই নৌকাগুলো অপেক্ষা করত আনলোড করার জন্য। পাশেই ব্রীজের নীচে মিনি সুন্দরবন নামে খ্যাত কেওড়া, সুন্দরীবন ছিল খুব আকর্ষণীয়। গাছে গাছে বানর, বনমোরগসহ নানা রঙের পাখির লাফালাফি দেখা যেত। মনোরম এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বহু দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক এখানে আসত। চিত্র জগতের অনেক শুটিংয়ের কাজ এখানে চলত। স্কুল কলেজের জন্য পিকনিকের বড় স্পট ছিল এটি। পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুস সবুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬২ সালে তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে ২টি সী প্লেনে কপোতাক্ষে নেমে এ নদের উপর পাটকেলঘাটার ঐতিহ্যবাহী ব্রীজটি উদ্বোধন করে পাটকেলঘাটার ঐতিহাসিক ফুটবল মাঠে জনসভা করেন। এই ব্রীজের স্প্যানের ফাঁকে ফাঁকে হাজার হাজার বুনো কবুতরের বাসা ছিল। ব্রীজের নিচে নদীর ঘাটে সার, সিমেন্ট, বালু, কয়লা ইত্যাদি বোঝাই সারি সারি কার্গো, স্টিমার ভীড় জমাত। নদীতে ভাটির সময় সামুদ্রিক ডলফিন বা শুশুক এবং বান দেখার জন্য ব্রীজের উপর রেলিং ধরে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত অনেক পথিক। অথচ সেই কপোতাক্ষ আজ শুধুই স্মৃতি।
একাবিংশ শতকের প্রথম দশক থেকে এ নদী ভরাট হওয়া শুরু করেছে। তাই আজ আর নেই তার অপরুপ সৌন্দর্য, ঢেউ ও স্রোত। সারা দেশের নদীর ন্যায় কপোতাক্ষ আজ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পলি পড়ে ভরাট হওয়ায় সরকারের কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের কারণে বর্তমানে কিছুটা জলাবদ্ধতা দূর হলেও আগের কপোতাক্ষীর সেই স্বচ্ছ শুভ্র জল, ব্রীজের নীচে বুনো কবুতরের ডাক, মাঝিদের দাড়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, জোয়ারের সাম্পান ভাসিয়ে মাঝির সেই ভাটিয়ালি গান কি আর কখনো শুনতে পাওয়া যাবে? পাটকেলঘাটার কপোতাক্ষের সেই স্মৃতির কথা স্মরণ করলেই যেন মনে পড়ে যায় বিশ্ব কবি রবী ঠাকুরের সেই গানের কথা, “পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সেকি ভুলা যায়/ আর আর একটি বার আয়রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়/ মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”
পাটকেলঘাটার সেই পুরানো বাজার ও কপোতাক্ষের ঐতিহ্য এখন শুধুই স্মৃতি
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/