Site icon suprovatsatkhira.com

যশোর রোড, বৃক্ষ কেটে রক্তক্ষরণ

তিতলির প্রভাব তখনও কাটেনি। অন্ধ্র ও উড়িষ্যায় আঘাত হেনে তিতলি ফের দাপট দেখিয়েছে পশ্চিম বাংলায়। ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে অঝোরে বৃষ্টি কলকাতার মানুষকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল। আমিও আবহাওয়ার ঘোরটোপে আটকা থাকার পর শেষতক দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। তাই পেট্রাপোলে যখন পৌঁছালাম তখন ঘোর অন্ধকার নেমেছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বৃষ্টির মধ্যে পূজোর বৈদ্যুতিক সাজসজ্জা আর হৈচৈ এ যশোর রোড যেনো নতুন প্রাণ লাভ করেছিল সেদিন ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায়।
তবু আমার হৃদয়কে তখন আরও একবার স্পর্শ করলো, ক্ষত বিক্ষত করলো কলকাতা হাইকোর্টের রায়। যে রায়ে বিচারপতিরা বলেছেন যশোর রোডের বৃক্ষ কেটে ফেলতে। দ্বিশতবর্ষী বিশালকায় বৃক্ষরাজি সেই যে ছায়া দিয়ে চলেছে তা কেটে ফেলা হবে হাইকোর্টের নির্দেশ পেয়ে, এতো ভাবতেই পারছিলাম না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন করে এই গাছ কাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম বাংলা পারেনি। এজন্যই কলকাতায় অনেকের মুখে শুনতে পেয়েছি। ‘বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। মনে হয় বাংলাদেশেই চলে যাই’।
রোপিত বৃক্ষগুলোর ইতিহাস সত্যিই প্রাচীন। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের জমিদার কালি বাবু ওরফে কালি চরন পোদ্দারের মা গিয়েছিলেন গঙ্গা ¯স্নানে। কিন্তু তাকে ইছামতি নদী পার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন নৌকার পাটনি মাঝিরা। বলেছিলেন আপনার ছেলে তো কৃপণ। কেনো সে নদীর ওপর সেতু বানিয়ে দেয় না। মা ফিরে গেলেন বাড়িতে। ছেলেকে বকাবকি করলেন। প্রশ্ন রাখলেন নদীর ওপর সেতু নেই কেনো। এরপর মা গেলেন অনশনে। সেতু তৈরি না করা পর্যন্ত অনশন ভাঙতে রাজী হননি তিনি। কিন্তু মাতৃভক্ত ছেলে কালি চরণ পোদ্দার মার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। বললেন শুধু সেতু নয়, আমি রাস্তা তৈরি করে দেবো। তুমি অনশন ভাঙ্গো মা। ছেলের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে মা অনশন ভাঙ্গলেন। কালি বাবু শুরু করলেন রাস্তা তৈরির কাজ। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থেকে কলকাতা পর্যন্ত দীর্ঘ এই রাস্তা কালিচরণ পোদ্দারের রাস্তা, যশোর রোড নামেই খ্যাত। ভারতের বনগাঁ হয়ে এই রাস্তার দুই ধারে তিনি লাগিয়েছিলেন বৃক্ষ। সেই বৃক্ষই এখন নিয়েছে বটবৃক্ষের রূপ। দুই শতাব্দী ধরে সুনিবিড় শীতল ছায়া দিয়েছে যশোর রোডের এই বৃক্ষ। সাক্ষী হয়ে আছে অনেক ইতিহাসের। মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড ছিল এক অবারিত দ্বার। আজও বেনাপোল বন্দর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থল বন্দর। আন্তর্জাতিক মানের এই বন্দরে চলছে কোটি কোটি টাকার আমদানি রফতানি বাণিজ্য। বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট রুকুনউদদৌলা তার ‘যশোর রোড ১৯৭১’ এ লিখেছেন এর ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ভিড়ে ঠাঁসা ছিল যশোর রোড। নিজ মাতৃভূমি পেছনে ফেলে আসার সময় তারা গেয়েছেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। তাদের চোখের জলে ভেসেছে যশোর রোড। গর্ভধারণ করা মা, ছোট ছোট শিশু আর বৃদ্ধ বৃদ্ধা ছাড়াও রোগীদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর তাক করা অস্ত্রের মুখে তারা দেশ ছেড়েছেন। সেই দিনের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের পূর্বে ভারতীয় মিত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক হয়ে এই যশোর রোড ধরে বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করিয়েছে। ভারি ট্যাংক নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে নেমেছে তারা। দেশত্যাগী শরণার্থীরাও বিজয়ের পর সগর্বে দেশে ফিরে এসেছেন। বেনাপোল পেট্রাপোল সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পতাকা এক মুহূর্তের জন্যও নামাতে দেয়নি মুক্তিপ্রিয় বাঙালি। আজও যশোর রোডের বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত দরজায় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত গায় বিজিবি বিএসএফ। সেখানে সকাল সন্ধ্যা সগর্বে উড়ছে বাংলাদেশ ও বন্ধু দেশ ভারতের পতাকা। গাছ কেটে ইতিহাসের সেই দেওয়াল ভেঙে ফেলা হবে এ খবর কারও জন্য সুখকর নয়। এই সীমান্ত দরজায় বাংলাদেশ অংশে বঙ্গবন্ধু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতি। ভারতীয় অংশে মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুল ইসলামের সৌম্য প্রতিকৃতি। সকাল সন্ধ্যায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্যালুট জানিয়ে নিজ নিজ দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
ইতিহাসের এই দেওয়াল কি ভেঙে ফেলা যাবে? কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য্য ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের বেঞ্চ গত ৩১ আগস্ট যশোর রোডের দুই পাশে থাকা ৩৫৬টি বৃক্ষ কর্তনের অনুমতি দিয়েছেন। এর আগে ভারতের পরিবেশ আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে বৃক্ষ কর্তন স্থগিত ছিল। তবে কলকাতা হাইকোর্ট এও বলেছে কর্তিত একটি বৃক্ষের বদলে সেখানে ৫টি করে বৃক্ষ লাগাতে হবে। অপরদিকে যানবাহন চলাচলে গতি ফেরাতে সেখানে ৫টি ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রস্তাবও করেছে হাইকোর্ট। তারপরও আমি বলবো, বারাসাত থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত এই ৬১ কিলোমিটার সড়কের দুই ধারের বৃক্ষ কেটে ফেলার অর্থ হবে ইতিহাসকে ক্ষত বিক্ষত করা।
শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ফিরে আসার সময় বৃষ্টিস্নাত আলো আঁধারে যশোর রোডের সেই বৃক্ষগুলো বারবারই চোখে পড়ছিল। স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল ১৯৭১ এর সেই দিনগুলোর কথা। অনেক রক্ত বয়ে গেছে এই সড়কের ওপর দিয়ে। অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে এই সড়কে। মায়ের অনশনে সম্মান জানিয়ে মাকে গঙ্গা¯স্নানে যাবার পথ করে দিতে যে মহতী উদ্যোগ কালিচরন পোদ্দার গ্রহণ করেছিলেন, যার কারণে শুধু রাস্তা নয় তৈরী হয়েছিল কপোতাক্ষ ও ইছামতির ওপর সেতু, আর যার দুই ধারে লাগানো হয়েছিল বৃক্ষের পর বৃক্ষ। সেই ইতিহাস, সেই ঐতিহ্য কি কখনও মুছে ফেলা যাবে? যে যশোর রোড আমাদের দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, যে বৃক্ষ দিয়েছে এতো শীতল ছায়া, এতো মায়া, এতো ভালবাসা, তা কি কর্তন করে ইতিহাসে রক্তক্ষরণ ঘটানো হবে? লেখক: জেলা প্রতিনিধি, এনটিভি ও দৈনিক যুগান্তর, সাতক্ষীরা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version