শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কঠিন সময়ে একটি শিক্ষিত জাতির স্বপ্নের কারিগর হিসাবে একসঙ্গে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। তিনি জানতেন, শিক্ষা খাতে অর্থ ব্যয় একটি দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে উপযুক্ত বিনিয়োগ। বাংলার এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে জনশক্তিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর অনেক দিন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা চোখে পড়েনি। ২১ বছর পর তার সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে দৃষ্টিপাত করেন। মূলত তখন থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভগ্নদশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে। ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা আবার একসঙ্গে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ২০১৪ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা ঘোষণা করেন।
গত তিন বছরে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ, সব ধরনের শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে একীভুত শিক্ষা সেতু গঠন, যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ করে বই উৎসব পালন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, ঝখওচ বরাদ্দ থেকে দরিদ্র শিশুদের জন্য পোশাক, খাতা-কলমের ব্যবস্থা করা, কর্মকর্তাদের ই-মনিটরিং পরিদর্শন ব্যবস্থা উদ্ভাবনী বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মা সমাবেশ, হোম ভিজিট করে উপস্থিতি বৃদ্ধি, মানসম্মত পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, প্রাক-প্রাথমিক কক্ষ সুসজ্জিতকরণসহ বিদ্যালয়ের ভবন আকর্ষণীয়করণ প্রভৃতি বহুমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে এ সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের রূপকার হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে। আমি মনে করি, মানসম্মত শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কার্যক্রম চলমান হলেও আমরা মানসম্মত শিক্ষার দোরগোড়ায় প্রবেশ করেছি মাত্র।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, নি¤েœাক্ত কিছু বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সদয় সৃষ্টি দিলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ আরো ত্বরান্বিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
১. প্রাথমিক শিক্ষার মূল সমস্যা হলো- আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা হতাশা নিয়ে কাজ করেন। উন্নত অন্য কোন চাকরি পেলে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। তাই তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা দরকার।
২. শিক্ষকরা মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করবেন- এটাই তার মূল কাজ। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষকদের অন্তত ৩০টি রেজিস্টার হালনাগাদ রাখা, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, প্রায় বছর জুড়ে প্রশিক্ষণ, সমাপনী পরীক্ষা প্রস্তুতি ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই এসব কাজে বিদ্যালয় প্রতি একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের পাঠদানে আরো অধিক মনোযোগী করা দরকার।
৩. প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে লোকবল সংকট আছে। এছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শনের বাইরে তাদের তথ্য-উপাত্ত আদান প্রদানসহ এত বেশি দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় যে, গড়ে দুই-তিন মাসেও সব কটি বিদ্যালয় পরিদর্শিত হয় না। তাই প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিতে হবে।
৪. আমরা সবাই জানি, সরকারের সামর্থ সীমিত। প্রাথমিক শিক্ষা খাতে যা বরাদ্দ আসে, তাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর চাহিদা মেটে না। সুতরাং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় ধনবান, প্রবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে।
৫. সর্বশেষ একটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই, তা হলো, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউশন বা কিছু শিক্ষকের মানসিকতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক শিক্ষকই আছেন যারা বিদ্যালয়ে সময় মত আসা-যাওয়া করেন না, পাঠদানে মনোযোগী নন। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষক রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিচার শালিসে জড়িত, যা শিক্ষকদের পেশার সাথে একেবারেই বেমানান। সুতরাং সম্মানিত শিক্ষকদের আরো বেশি আন্তরিক হওয়ার আহবান জানাই।
৫. হঠাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে একটি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে দেখেছি, চক-ডাস্টার, বই, পাঠ পরিকল্পনা উপকরণ ছাড়াই পাঠদান করতে শ্রেণিশিক্ষক শ্রেণিকক্ষে গিয়েছেন। ধরে নেওয়া যায়, তিনি কোন প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে গিয়েছেন। পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে গেলে তিনি পরিকল্পিতভাবে ক্লাসটি নিতে পারতেন। শ্রেণিশিক্ষক বাংলাদেশের বিষয়ে পাঠদান কালে যদি বাংলাদেশের মানচিত্র শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পাঠদান কালে যদি একজন বীরশ্রেষ্ঠের ছবি দেখান তাহলে পাঠটি যেমন অকর্ষণীয় হবে, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীর মনে তা অনেক দিন থাকবে।
৬. স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার যে সব কারণ রয়েছে সেগুলো ছাড়াও দেখা যায়- ক) শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের অসচেতনতা খ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরানন্দ শিক্ষা ব্যবস্থা, গ) শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার বিরক্তিকর একটানা সময়সূচি ঘ) বছরের পুরো সময় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করানোর ফলে পঠন-পাঠন কার্যক্রমে বৈচিত্র্যময় পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া, ঙ) দিনব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা না থাকা চ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত সমস্যা ছ) বেশির ভাগ শিক্ষকের গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাঠদান জ) পরীক্ষামুখী শিক্ষা কার্যক্রম ঝ) উপেক্ষিত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি ঞ) স্কুলগুলোয় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব ট) অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব ঠ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী টেনে নিয়ে আসার জন্য বহু কোচিং সেন্টারের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও নানমুখী প্রচেষ্টা ড) গবেষণাহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ইত্যাদি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে হলে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে।
এছাড়াও প্রয়োজন শিক্ষক, অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির আন্তরিকতা। যদি শিক্ষকগণ যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন, পাঠ পরিকল্পনা ও উপকরণ নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যান এবং আকর্ষণীয়ভাবে পাঠদান করেন তাহলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া অনেক কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। এছাড়া যদি ম্যানেজিং কমিটি নিয়মিত মা সমাবেশ করে, অভিভাবক সমাবেশ করে, বাল্যবিবাহের কুফল গুলো মায়েদের এবং শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বলেন, এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, ইভটিজিং বন্ধে সামাজিক আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে পর্যাপ্ত খেলাধূলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করলে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে অপরিহার্য স্তম্ভ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। একটা ভালো বীজ থেকে যেমন একটা গাছ মহীরুহ হয়ে ওঠে, তেমনি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। কারণ প্রাথমিক শিক্ষাই চলমান মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার বীজ।
সুতরাং আসুন শিক্ষিত জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত শক্ত করতে সংশ্লিষ্ট সবাই যে যার জায়গা থেকে নিঃস্বার্থ সেবা দান করে ইতিহাসের অংশ হই।
লেখক: চেয়ারম্যান, সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক, দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগ।
মুক্তমত- মানসম্মত শিক্ষা: সমস্যা ও সম্ভাবনা
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/