Site icon suprovatsatkhira.com

প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সাতক্ষীরা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

আরিফুল ইসলাম রোহিত: 

প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সাতক্ষীরা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। ইতোমধ্যে জেলার ৩ হাজার ৪শ ৮০ জনকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে কেন্দ্রটি। একই সাথে ১৪টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে হাজার হাজার বেকার যুবক-যুবতীকে দেখাচ্ছে আশার আলো।
সাতক্ষীরা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে বিনেরপোতায় প্রায় দুই একর জমির উপর ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে ‘দক্ষতা অর্জন করি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ি’  স্লোগানকে   সামনে রেখে চলছে বেকার যুবক-যুবতীদের দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির বিশাল এক কর্মযজ্ঞ।
সাতক্ষীরা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, এখানে সাতটি ট্রেডে বেকার জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ট্রেডগুলো হলো, আর্কিটেকচারাল ড্রাফটিং উইথ অটোক্যাড, কম্পিউটার অপারেশন, অটোমেকানিক্স উইথ ড্রাইভিং, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ও হাউজ কিপিং।
এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে চরছে আরও সাতটি ট্রেড।
এগুলো হলো- মেশিন টুলস অপোরেশন, সিভিল কন্সট্রাকশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং মেশিন অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষণ, কোরিয়ান ভাষা প্রশিক্ষণ, আরবী ভাষা প্রশিক্ষণ।
এসব ট্রেডের আওতায় বিদেশগামী মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তুলছে সাতক্ষীরা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
সূত্র আরও জানায়, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিয়মিত ব্যাচ এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্বনির্ভর ব্যাচে বিভিন্ন ট্রেডে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণার্থীদের উপস্থিতি সাপেক্ষে উপবৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া বাইরে থেকে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের জন্যে রয়েছে ১৪৪ আসন সম্বলিত চারতলা ডরমেটরি ভবন। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষের বাস ভবন ও পরিদর্শনরত অতিথিদের জন্য গেস্ট হাউজসহ তিন তলা আবাসিক ভবন।
এদিকে, প্রতিষ্ঠানটি চালু হওয়ার পর প্রশিক্ষক কর্মচারীর মঞ্জুরীকৃত পদ ছিল ৮৫টি। কিন্তুু এখন পর্যন্ত আলাদা কোন পদ সৃষ্টি হয়নি। তবে সাতটি ট্রেডে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো কর্তৃক অস্থায়ীভাবে সাতজন ইন্সট্রাক্টর ও তিনজন স্কীল্ড ওয়ার্কার পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
সম্প্রতি, এসইআইপি প্রকল্পের অর্থায়নে চারটি ট্রেডে একজন জব প্লেসমেন্ট কর্মকর্তা ও চারজন প্রশিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির পদে ৮ জন অস্থায়ীভাবে কর্মরত আছে।
প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদানকৃত সনদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাই এখানে বেকার যুবক-যুবতীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরুর পর থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪শ ৮০ জন বিদেশগামী প্রশিক্ষণার্থী তিনদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে পৌঁছে কাজ শুরু করেছে। এসব প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে মালয়েশিয়াতে ১ হাজার ৬শ ১৪ জন, সৌদি আরবে ৮শ ২০ জন, কুয়েতে ৩শ ৯০ জন, কাতারে ১শ ৮৫ জন, মালদ্বীপে ১শ ৩১ জন, ওমানে ৯৯ জন, ব্রæনাইতে ৫৯ জন, সিঙ্গাপুরে ৫২ জন, লেবাননে ৩৪ জন, ইরাকে ৩১ জন, বাহরাইনে ২৮ জন, জর্ডানে ১৪ জন, মরিশাস ৯ জন, চীনে ৪ জন, সিসিলিতে ২ জন, তুরস্কতে ২ জন এবং রাশিয়া, হংকং, সুদান, সাইপ্রাস, ডেনামার্ক ও ভিয়েতনামে ১ জন করে রয়েছে। এসব বিদেশগামী প্রশিক্ষণার্থী জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
সূত্র আরও জানায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা থেকে ৮শ ৪২ জন, কালিগঞ্জ উপজেলার ৭শ ১৮ জন, কলারোয়া উপজেলার ৬শ ৩৬ জন, শ্যামনগর উপজেলার ৫শ ৯ জন, তালা উপজেলার ২শ ৬৯ জন, দেবহাটা উপজেলার ২শ ৫৮ জন ও আশাশুনি উপজেলার ২শ ৫৭ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিদেশে যাত্রা করেছে।
এদিকে, ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর থেকে হাউজকিপিং ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ২শ ৭ জন নারী প্রশিক্ষণার্থী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে ১শ ৬৯ জন, ওমানে ১৯ জন, কাতারে ৯ জন, লেবাননে ৪ জন, আরব আমিরাতে ৩ জন, জর্ডানে ২ জন ও কুয়েতে ১ জন রয়েছে।
এছাড়া, সাতক্ষীরা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২ মাস মেয়াদী ৪০টি আসনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে। এসএসসি পাসকৃত শিক্ষার্থীরা আবেদনের মাধ্যমে এই ভাষায় দক্ষ হতে পারে। এছাড়া নতুন ভাবে রোড বিন্ডার, প্লাম্বিং অ্যান্ড পাইপ ফিটিংস ট্রেডে ৪০ জনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন Skills for Employment Investment Program (SEIP) এর অর্থায়নে ৩০টি আসনে চার মাস মেয়াদী কোর্স চালু করা হয়েছে। ট্রেডগুলো হলো- সুইং মেশিন অপারেশন, আইটি সাপোর্ট সার্ভিস, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক্যাল ইন্সটলেশন অ্যান্ড মেইনট্যানেন্স। এসব কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণার্থীদের যাতায়াত ভাতার জন্য দৈনিক ১০০ টাকা হারে প্রদান করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, কম্পিউটার অপারেশন ট্রেডে রয়েছে অত্যাধুনিক ৩৫টি কম্পিউটার। রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর রুম। এছাড়া রয়েছে ৩১টি কম্পিউটার সমৃদ্ধ অটোক্যাড ল্যাব। গার্মেন্টস ওয়ার্কশপ প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে ৬৫টি বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক সেলাই মেশিন। এছাড়া ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে দুটি কার ও একটি মোটর সাইকেল।
সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণের আওতায় কম্পিউটার অপারেশন ট্রেডে ৩শ ৫৫ জন, ইলেকট্রনিক্স ট্রেডে ১শ ২০ জন, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ট্রেডে ৮০ জন, অটোক্যাড ট্রেডে ১শ ৩২ জন, অটোমোবাইল ট্রেডে ১শ ৪৫ জন, ইলেকট্রিক্যাল ট্রেডে ১শ ৩০ জন, গার্মেন্টস ট্রেডে ১শ ৬০ জনসহ সর্বমোট ১ হাজার ১শ ২২ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।
এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানে ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু রয়েছে। যেখানে আসন সংখ্যা ৪০টি করে। এসব ট্রেড হল- অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল, গার্মেন্টস, কম্পিউটার অপারেশন, ইলেকট্রনিক্স, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ও অটোক্যাড।
ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ট্রেডের প্রশিক্ষণার্থী আবুল হাসান বলেন, এই প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় নিজেদের দোকানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। শুধু আমাদের কর্মসংস্থান হবে তা নয় এর সাথে সাথে আরও কিছু মানুষ কর্মে জড়িয়ে যাবে। আমাদের জেলায় এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালু হওয়ায় আমরা দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ পেয়েছি। এ কারণে কয়েক বছর পরে হয়তো এলাকার বেকারত্ব শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
কম্পিউটার অপারেশন ট্রেডের নাজমুল তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, এই ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে চাকুরীর আবেদন করতে পারছি। এখানকার প্রশিক্ষণ শেষে যে সনদ দেওয়া হয় তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় আমাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
বিদেশগামী প্রশিক্ষণার্থী মো. হায়দার রহমান বলেন, এখানে তিন দিনের ট্রেনিং করতে এসেছি। বিদেশে কীভাবে যেতে হবে, কী কাজ করতে হবে, কোন সমস্যায় পড়লে কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া হচ্ছে। এসব ধারণা নিয়ে বিদেশে গিয়ে আমরা দেশের মান আরও বেশি সমুন্নত রাখতে পারবো। আমাদের এখানে এই কেন্দ্রটি না থাকলে খুলনা অথবা যশোর গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। কিন্তু এখন আর দূরে যাওয়া লাগে না। বিদেশগামী জনশক্তি উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠান বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এতে এই জেলার অনেক মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যেতে পারছে।
কারিগরি প্রশিক্ষণের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. মোছাব্বেরুজ্জামান বলেন, জেলার বেকার ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে উৎসাহী হচ্ছে। তারা নিজেরা দক্ষ হচ্ছে আবার কেউ কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। খুব বেশি দূরে নয় যখন এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলার বেকারত্ব শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপহার জেলাবাসীর জন্য আশির্বাদস্বরূপ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version