Site icon suprovatsatkhira.com

দস্যুমুক্ত হচ্ছে সুন্দরবন, সুদিনের আশায় উপকূলের জেলেরা

আহসানুর রহমান রাজীব: কিছুদিন আগেও সুন্দরবনে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতো দস্যুরা। মুক্তিপণের টাকা দিতে দেরি হলে তাদের ওপর চালানো হত অমানুষিক নির্যাতন। বনজীবীদের এই দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি দিতে সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয় সরকার। এর পর গেল দুই বছরে আত্মসমর্পণ করেছে প্রায় আড়াইশ’ জলদস্যু। জমা পড়েছে তিন শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ দুই হাজার গুলি। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) বাগেরহাট জেলা স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে আরও কয়েকটি দস্যু বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করবেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এলাকার জেলেরা নির্ভয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।
তবে এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হলেও দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষ্য, দস্যুদের অস্ত্রসহ অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। অন্যথায় তাদের ছত্রছায়ায় নতুন করে দস্যুবাহিনী মাথা চাড়া দিতে পারে। সুন্দরবন আবারও ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হতে পারে।
অবশ্য এই আত্মসমর্পণের খবরে স্বস্তি ফিরেছে স্থানীয় জেলেদের মনে। একইসঙ্গে কাক্সিক্ষত পরিমাণ মাছ শিকার ও রাজস্ব অর্জনের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপর আবার মাছ ধরা শুরু করেছেন জেলেরা। সুন্দরবনের ছোট-বড় নদী, খালসহ ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরবেন তারা। তবে অন্য বারের তুলনায় এবার তারা সুন্দরবন এলাকা ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিজেদের অনেক নিরাপদ মনে করছেন। আগামী চার-পাঁচ মাস উপকূলের চরগুলোতে অবস্থান করে মাছ ধরা, শুকানো ও বিক্রি করবেন জেলেরা।
জেলেরা বলছেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার পাশাপাশি তাদের বড় ভয় ছিল জলদস্যুদের নিয়ে। জলদস্যুদের জন্য সাগরে নির্বিঘেœ মাছ ধরা যেতো না। মাছ ধরতে গিয়ে দস্যুদের হাতে পড়লে আয় তো দূরের কথা, জাল-নৌকা সব হারাতে হতো। থাকতো প্রাণের ঝুঁকিও। মুক্তিপণ দিতে গিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরতে হতো লোকালয়ে। সুন্দরবন এলাকা দস্যুমুক্ত হলে এমনটি আর হবে না ভেবে নিরাপদ বোধ করছেন তারা।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকার জেলে মানবেন্দ্র বিশ^াস জানান, বনে আর ডাকাত নেই এই খবরে আমরা আনন্দিত। এক সময় যারা ডাকাতের ভয়ে সুন্দরবনে যেত না তারা আবার নতুন করে বনে মাছ মারতে যাবে।
একই এলাকার জেলে এনামুল জানান, আমরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছি। আমরা নিরাপদে মাছ ধরতে পারবো।’
কাকড়া ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমাদের জন্য বড় ভয় ছিল ডাকাত (দস্যু)। ডাকাত না থাকলে আমাদের আর কোনও ভয় নেই।’
এবার সাগরে মাছ ধরা নিরাপদ হবে বলে মন্তব্য করেন হরিনগর মৎসজীবী সমিতির সভাপতি আইয়ুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘অন্য বার ডাকাতের ভয় ছিল। এবার ডাকাত নেই। নিরাপদে জেলেরা মাছ ধরতে পারবে। আমরা চাই সব সময় যেন এমন পরিবেশ বজায় থাকে।’
সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে প্রায় এক দশক সময় ধরে কাজ করছেন যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম। তিনি সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে বলেন, ‘সুন্দরবন গহীন বন। সেখানে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করা সত্যিই অসম্ভবের মতো ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো চেষ্টা করছেই, তাদের পাশাপাশি যদি দস্যুদের সারেন্ডার করানো যায়, সে লক্ষ্যে কাজ শুরু। কেননা, অভিযানে তো পুরো বাহিনী ধরা পড়ে না। আবার সব অস্ত্রও পাওয়া যায় না। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ঘেরাও দিয়ে অভিযান চালানোও সম্ভব না। কাজেই তাদের যদি বুঝিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে দস্যুবাহিনীগুলো বিলুপ্ত হবে, অস্ত্র-গুলিও জমা হবে।’ সবার সহযোগিতায় সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার পর আর যেন কোনও দস্যুবাহিনী গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মোহসীন-উল হাকিম বলেন, ‘সবার সহযোগিতায় এই সফলতা আসতে যাচ্ছে। এই পরিবেশটা দীর্ঘস্থায়ী করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যারা দস্যুতার পৃষ্ঠপোষক তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা শুনছি। কিন্তু দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। কিছু ব্যবসায়ী নানাভাবে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেটা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। সবকিছুর মূলে তারা। কিছু ব্যবসায়ী আছে যারা সুন্দরবনে মাছের ব্যবসা করেন। তারা নিজেদের স্বার্থেই এই দস্যুদের লালনপালন করেন। সুন্দরবনে আবার দস্যুতা শুরু হবে কিনা, সেজন্য তারাই বড় হুমকি। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
খুলনা র‌্যাব-৬-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার হাসান ইমন আল রাজীব সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে বলেন, “আগামী ১ নভেম্বর সকাল ১০টায় বাগেরহাট জেলা স্টেডিয়ামে দস্যুদের শেষ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সঙ্গে বনমন্ত্রী, জেলার সব সংসদ সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তার কার্যালয় থেকে অংশ নেবেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা দেবেন, ‘আমি সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করলাম।’”
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য, বন বিভাগের কর্মকর্তা, র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. আমির হোসাইন চৌধুরী সুপ্রভাত সাতক্ষীরাকে বলেন, ‘দস্যুমুক্ত করতে পারাটা সবার জন্য একটা বড় সাফল্য। বিশেষ করে এলাকার মানুষের জন্য। আগামী বৃহস্পতিবার আরও কিছু দস্যুর সারেন্ডার প্রোগ্রাম আছে। সেই দিক থেকে সুন্দরবন এখন অনেকটাই নিরাপদ বলতে হয়। যদিও ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা এখনও আছে। তবে আগে যে দস্যুদের মেজর একটা থ্রেট ছিল আমাদের জেলে, মাওয়ালীদের জন্য, এখন আর সেটা নেই। এখন অনেক স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। আগে যেরকম হুমকি ছিল, জেলেদের মধ্যে ভয় ছিল, সেই পরিবেশটা এখন আর নাই।’

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version