‘মরিতে চাহিনা এই সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাচিবার চাই’- কবির এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা সকলেই একমত। রূপরস, গন্ধ আর মায়া মমতায় ঘেরা এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। শুধু মানুষ নয় সৃষ্টিকূলের প্রতিটি প্রাণীই এই সুন্দর পৃথিবীতে চিরদিন বাঁচতে চায়। কিন্তু কারও পক্ষেই তো আর চিরদিন বাঁচা সম্ভব নয়। এ যাবৎ আবিষ্কৃত সকল গ্রহের মধ্যে এখনও পৃথিবী নামক গ্রহটি মানবসহ সকল প্রাণিকূলের বসবাসের জন্য উপযোগী এবং নিরাপদ। কিন্তু মানুষের কৃতকর্মের জন্য আস্তে আস্তে এই গ্রহটি মানবসহ সকল প্রাণিকূলের বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ডাইনোসরসহ অনেক শক্তিশালী প্রাণি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে আরও অনেক উদ্ভিদ এবং প্রাণি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। যাকে আমরা সংক্ষেপে বলছি ক্লাইমেট চেঞ্জ। আর আবহাওয়ার এই পরিবর্তন হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে সভ্যপ্রাণি মানুষের দ্বারা, যারা নিজেদের বাসস্থানকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যচ্ছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মানব সভ্যতার জন্য আজ সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সুদূর প্রসারী প্রভাবের ফলে ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষের বিবিধ মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তা। এসব চাহিদা ও নিরাপত্তার মধ্যে মানুষের জীবন, সম্পদ, খাদ্য, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য, বসতি, ভূমি, জীবন-জীবিকার উৎস কর্মসংস্থান এবং তাদের উন্নয়নের অধিকারও রয়েছে। জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যাকে উন্নয়ন, দারিদ্র্য নিরসন ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। কেননা, জলবায়ু সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লাখ লাখ লোক তাদের বসতভিটা ছেড়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হবে তাদের মানবাধিকার, (যথা- খাদ্য ও পানি) উন্নয়নের অধিকার এবং তাদের নিজস্ব সমাজ সংস্কৃতিতে বসবাসের অধিকার থেকে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রায় সব পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু এই ক্ষতিকর প্রভাব তাদের ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, উন্নয়নের ইতিহাস ও সরকারের সক্ষমতা তথা শাসন পদ্ধতি ও ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও জলবায়ু সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করে তুলবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিক বৃদ্ধিসহ দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততার প্রবেশ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা অন্যতম। বিশ^ সম্প্রদায় যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশি^ক দারিদ্র্য ও মানুষের খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি সমস্যা, সামাজিক নিরাপত্তার সমস্যা ও তীব্রতর করবে। আঞ্চলিক বৈষম্য তীব্রতর ও মৌলিক মানবাধিকারগুলো লঙ্ঘিত হবে। এসবের ফলে নিকট ভবিষ্যতে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুভিটা চ্যুত হতে পারে। ফলে বিশ^ব্যাপী জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো নিন্ম,ব-দ্বীপঅঞ্চল এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়বে। গ্রাম থেকে শহরে, এমনকি দেশ থেকে দেশে (বিপদাপন্ন দেশ থেকে অন্যদেশে) মানুষের স্থানান্তর বৃদ্ধি করবে। এই অভ্যন্তরীণ ও বহিঃদেশীয় স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি করবে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীই এ ক্ষেত্রে সবচেয় চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডকে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের তালিকায় রেখে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করেছে এমন অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকেটা পূর্বাস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে পরিবেশ বিপর্যয়। (এডিবি প্রতিবেদন তারিখ-১৪-৭-১৭)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রমাগত জীবাশ্ম জালানীর ব্যবহারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে, বৃষ্টির সময় ও পরিমাণে পরিবর্তন ঘটছে যা একই সঙ্গে জীবনযাত্রায় মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি ছাড়াও যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অস্থিতিশীল জলবায়ু পরিবর্তন। ফলে কয়েক দশকের উন্নয়ন অগ্রগতিতে পরিবর্তন যথেষ্ট হয়ে ওঠেনি। শিল্প দূষণের ফলে তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়ার দেশগুলোর গরিব মানুষ। এজন্য বিশ^ উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনা জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। যা অনেক দেশের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। বিপর্যয়ের পাশাপাশি পর্যটন ও মৎস্য খাত ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতিরিক্ত বরফ গলায় বন্যা ও খরা কৃষিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরতা বাড়লেও সময়মত তা পাওয়া না গেলে কৃষিতে ফসলহানি হবে ব্যাপক। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তাপমাত্রা হ্রাস করা না গেলে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এশিয়ার ৫২ হাজার বয়স্ক মানুষ মারা যাবে। একই সময়ে ডায়রিয়ায় আরো ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষ মারা যাবে ম্যালেরিয়ার ও ডেঙ্গু রোগে। আবহাওয়াগত এধরনের বিপর্যয় শুধু এশিয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বরং বিশ্বের অন্য স্থানের সঙ্গেও তা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। গত ২৫ বছরে এশিয়ায় মাথাপিছু আয় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেলেও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে এখনো এ অঞ্চলে বিশ্বের অধিকাংশ গরিব মানুষ বাস করছে।
আবহাওয়ার এই পরিবর্তন রোধে যুব সমাজের করণীয়:
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যুব সমাজ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দুইভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চল। সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে ২ দশমিক ৫ মিলিমিটার করে। আর আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। ফলে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, সিডর, আইলা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, বরফগলা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, ফসল উৎপাদন হ্রাস, মৎস্য উৎপাদন হ্রাস ও বিলুপ্তি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আ্যসিড বৃষ্টি ও নতুন নতুন কঠিন রোগ সৃষ্টির বাস্তবতায় পরিবেশের বিপর্যয় আর ভবিষ্যতের ভয় নয় বিপদ এখন দোরগোড়ায়।
বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৫% তরুণ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ৮৫% যুবকই উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ৮৯.৫% হবে। তাই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনসখ্যার বৃহদাংশ তরুণ এই বৃহদাংশ তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বদেশ প্রেমের সমন্বয়ে তাদেরকে সচেতন পরিবেশ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের জ্ঞান, মেধা-মনন ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। আর এ জন্য তরুণদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ সম্পর্কিত কুইজ, বিতর্ক, ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়নস প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাংকন এবং শোভাযাত্রার আয়োজন করা যেতে পারে। তরুণদের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে গবেষণা আবশ্যক। গবেষণার মাধ্যমেই পরিবেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো জানা যাবে এবং সমাধান করা যাবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে ও জনসচেতনতায় তরুণরা যে ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে তা নিন্মরূপ:
ক) পরিবেশ বিজ্ঞানে জ্ঞান রাখা: বাংলাদেশের মাত্র ১০-২০% জনগণ পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতন। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য অংশের পরিবেশ বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই তাদের পরিবেশ ও তার দূষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা উচিত।
খ) বায়ু দূষণ রোধে করণীয়:-
১. বায়ু দূষণের জন্য দায়ী NH4, CO, CO2, PB, DUST, Agricultural chemicals, C6H6 প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও পরিবেশকে এগুলোর ক্ষতি থেকে বাঁচানোর উপায় জনগণকে বলে দেওয়া।
২. ধূমপানের ধোঁয়া, যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার উপর জনমত সৃষ্টি করা।
৩. গ্রীন হাউজ গ্যাসের কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে য্ত্নবান থাকা প্রয়োজন।
৪. ওজোন স্তরে গর্ত হয়ে যে সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তা প্রতিরোধের উপায় জনগণকে জানানো উচিত।
৫. জনগণকে বন ও জলাশয় সংরক্ষণ ও ব্যাপক বৃক্ষরোপণে উৎসাহী করা।
৬. পুরোনো ও দুই ইঞ্জিন চালিত বাহন পরিহার করে প্রাকৃতিক গ্যাস (CNG) চালিত বাহন ব্যবহার করা।
৭. ধরণ অনুযায়ী আবর্জনাকে পৃথক করে জমা ও অপসারণ করতে উদ্বুদ্ধ করা।
৮. অতিরিক্ত এ্যারোসল ও অন্যান্য স্প্রে ব্যবহার না করা।
গ) পানি দূষণ প্রতিরোধ: পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে তরুণদের যা যা করা উচিত:
১. পানিতে আবর্জনা, কীটনাশক, সার বা বিষাক্ত দ্রব্য ইত্যাদি না ফেলা।
২. Water treatment plant স্থাপনে উদ্ধুদ্ধকরণ।
৩. উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
৪. ভূগর্ভস্থ পানির পরিমিত ব্যবহার।
৫. জমিতে সার বা কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জলাশয়ে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
৬. হাজারীবাগ ট্যানারী কর্তৃক বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের মতো কোন কলকারখানার বর্জ্যই যেন কোন জলাশয়ে পতিত হতে না পারে সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করা।
৭. কোন কোন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে ০.০৫ পিপিএম এর বেশি আর্সেনিক আছে তা জানা এবং এর বিষক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। প্রয়োজনে দূষণ অঞ্চলের মানচিত্র প্রস্তুত করা।
৮. পানি দূষণ রোধে জনসাধারণ ও তরুণরা মিলে স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ গ্রহণ করা। (যেমন: বদ্ধ জলাশয়কে কচুরিপনামুক্তকরণ)
ঘ) মাটিকে দূষণমুক্ত রাখা: মাটি দূষণ রোধে নি¤েœাক্ত কাজগুলো সম্পাদন করা যেতে পারে:
১. প্যালাস্টিক ব্যাগ, পলিথিন পরিহার।
২. বৃক্ষরোপণ, পাহাড় ও উচ্চভূমি রক্ষা ইত্যাদির দ্বারা ভূমিক্ষয় রোধে উদ্বুদ্ধকরণ।
৩. ভূমিতে অপরিকল্পিত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
৪. কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ।
৫. কৃষকদের Roation of crops নীতি অনুসরণের গুরুত্ব বুঝানো।
৬. ইটের বিকল্পে ব্লক ইট ব্যবহার।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের ও উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলো। এই ইটভাটার ফলে নষ্ট হচ্ছে ভূ-স্তরের ভারসাম্য, ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ এবং দেখা দিচ্ছে মারাত্মক সব জটিল রোগ। উন্নত বিশ^সহ সব দেশের বালু ও সিমেন্ট দিয়ে প্রস্তুতকৃত ব্লক ইট ব্যবহৃত হচ্ছে; যার গুণগত মান পোড়া ইট থেকে অনেক ভাল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে বহমান ৫৪টি বড় নদীসহ অসংখ্য ছোট নদী ও খাল বালুতে ভর্তি হয়ে আছে। এসব বালু ব্যবহার করে উন্নত মানের ব্লক ইট তৈরি করলে একদিকে নদীগুলো খনন হয়ে যাবে, অপরদিকে মানসম্পন্ন ব্লক ইট প্রস্তত হবে। ফলে সাশ্রয় হবে কয়লা, ফার্নেস অয়েল, আমদানির জন্য ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রা, নিরুৎসাহিত হবে গাছ কাটা। নিচু হবে না দেশের ভূমি। একই সাথে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে পরিবেশের মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে।
ঙ) শব্দ দূষণ রোধ: শব্দ দূষণ রোধে আমাদের করণীয় নিন্মরূপ:
১. জোরে রেডিও/টিভি/গান না বাজানো।
২. হাইড্রোলিক হর্ণের ব্যবহার/অতিরিক্ত শব্দে মাইকের ব্যবহার/নির্মাণ কাজ ও কারখানার উচ্চ শব্দ বন্ধ/ক্যাম্পাসে
গোলাগুলো বোমাবাজি/বিকট আওয়াজে শ্লোগান ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা।
৩. শব্দ শোষক যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. পরিবেশ সংক্রান্ত আইন মেনে চলা।
৫. স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা।
৬. সামাজিক দায়িত্ব পালন করা।
৭. পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকতে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুবদের সামনে মূল করণীয়:
ক) জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ২০১২ সাল পরবর্তী প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৃহত্তর অংশগ্রহণে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন নিরসনের কৌশল এবং এ লক্ষ্যে কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার জন্য যুবরা আন্তর্জাতিক যুব সংগঠন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি ও বড় বড় রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
খ) অপেক্ষাকৃত জলবায়ু ও পরিবর্তিত অবস্থায় কীভাবে টিকে থাকা যায়, বা কার্যকর অভিযোজন করা যায়, এর কৌশল উদ্ভাবন
করতে হবে। কেননা এ অবস্থা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে চলমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির আত্মঘাতী সর্বনাশ থেকে দুনিয়াকে বাঁচাতে চাইলে মানব জাতির হাতে আর মাত্র তিন বছর সময় আছে। একথা উঠে এসছে বিখ্যাত সাময়িকী নেচার-এ। পরিবেশ-জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষয়ে খ্যাতিমান এই পত্রিকা সম্প্রতি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের বরাতে জানায়, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমণ ইতিবাচক হারে কমিয়ে আনার কাজ শুরু করতে এখন আর মাত্র ৩ বছর সময় হতে আছে। এই সময় সীমার মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমণ কমানো না গেলে প্যারিস ঘোষণায় বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। একই সাথে পরিস্থিতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে বাংলাদেশের সাফল্য:
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার পরেও নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে গোটা বিশে^ও মাঝে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিশে^র কোন দেশে নিজস্ব তহবিলে এ ধরণের ফান্ড গঠনের কোন নজির নেই। এ পর্যন্ত এই ট্রাস্ট ফান্ডকে সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া ৩ হাজার কোটি টাকায় গ্রহণ করা হয়েছে ৩৬৮টি প্রকল্প। পাশাপাশি বিষয়টির সবোর্চ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটিও বিশে^র প্রথম। প্রণয়ন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইনসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা। আর এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’।
আলোচনার এই শেষ প্রান্তে এসে বলতে পারি, জলবায়ুর পরিবর্তন প্রশমন, দারিদ্র্য নিরসন, টেকসই উন্নয়ন ত্বরানি¦ত করা এবং অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমবণ্টন এ ক্ষেত্রেও অত্যন্ত জরুরি, যার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সমঝোতা ও সমন্বিত উদ্যোগ। এটা নিশ্চিত করতে দরিদ্র ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকারগুলো রক্ষা করতে হবে; জরুরি ও তাৎক্ষণিকভাবে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন অবশ্যই কমাতে হবে।
যদি এখনই বিশ^ উষ্ণায়ন থামানো না যায়, তবে গোটা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য হঠাৎ করে ভেঙে পড়তে পারে নিউইয়র্কর টুইন টাওয়ারের মত। বর্তমানে আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে অতি নিকট ভবিষ্যতে এই সুন্দর গ্রহটি মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে এবং এক পর্যায়ে তা হয়ে পড়তে পারে শুক্র গ্রহের মত একটা উত্তপ্ত গ্রহে। যেখানে কোন একদিন যে জীবজগৎ ছিল তা হবে সৌরজগতের বাইরের ভিন গ্রহবাসীর জন্য এক গবেষণার বিষয়।
তাই আবারও কবির ভাষায়, ‘….. এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
তাই আসুন আগামী শতাব্দীর পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য আমরা সকলে মিলে একযোগে কাজ করি।
(তথ্যসূত্র: ১. bangladeshpress24.com, ২. এডিবির জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন (১৪.৭.১৭ তারিখে প্রকাশিত)
৩. দৈনিক প্রথম আলো, ৪. ইন্টারনেট।) লেখক: সহকারি পরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা।
উত্তপ্ত হচ্ছে ধরণী, শঙ্কিত বিশ্বাসী: যুব সমাজের করণীয় : মো. আব্দুল কাদের
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/