রাজধানী থেকে কিছুদূর যেতেই শুরু হলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। রাচির বিখ্যাত গুণ্ডু গুণ্ড্রু জলপ্রপাত দেখতে আমাদের মনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে গাড়ির চাকা। পথের ধারেই পাহাড়ি বুনোফুল আর অজানা গাছের সারি আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছিল দু’হাত প্রসারিত করে। পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ। এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সিঁড়ির ধারে। তর সইছে না কারো। সৃষ্টির সেরা সুন্দরীকে কাছ থেকে মন ভরে দেখতে কে না চায়। এক নাগাড়ে সিড়ি ভাঙছি। যারা আগেই জলপ্রপাত দেখে সিঁড়ি টপকিয়ে ফিরে আসছে, ঘেমে সাতরানো মুখ হলেও প্রশান্তির ঝিলিক তাদের চোখে-মুখে। ৭৪৫টি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যখন জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছলাম, শিউরে উঠলাম। অবশ্য নিচে নামার আগেই জলপতনের সুর তরঙ্গ কানে আসছিল। ঘোমটা টানা লাজুক অথচ অসম্ভব সুন্দরী বধূর মতো লাগল তাকে। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা পাঁচিল। তার মধ্যেই সৌন্দর্যের লীলাখেলা। বুনো জঙ্গলের মাঝে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে অবিরাম নিচে আছড়ে পড়া জলরাশি মনকে তো বারেবার ছুঁয়ে যাবেই।
জানা গেল, গুণ্ডু গুণ্ড্রু জলপ্রপাতের উৎপত্তি হয়েছে সূবর্ণরেখা নদী থেকে। সূবর্ণরেখা আপন খেয়ালে চলতে চলতে ওপর থেকে নেমে এসেছে নিচে। এটাই জলপ্রপাত। জলপতনের স্থান থেকে এর উচ্চতা ৯৮ মিটার। জলপ্রপাতের তলাতেই বিশাল জলাশয়। অনেকেই মেতে উঠেন পাহাড় স্নানে। শত বছরের ধেয়ে নামা জলরাশিতে পাথর ক্ষয়ে বিচিত্র রং ধারণ করেছে। রপাহাড়ে মূলত বেদিয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। পাহাড়ে জুম চাষ ও পাহাড়ের খাদে খাদে দোকানদারী করে তারা জীবীকা নির্বাহ করে। এছাড়া মাশরুম ও চাচ দিয়ে ফুলের তোড়া তৈরি করে বুনো বাঁশের খাপে ভরে বিক্রি করেও জীবীকা নির্বাহ করেন অনেকেই। অনেকেই শুকর পালন করেন।
বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো, যখন শুনলাম তাদের প্রধান বাজার নাকি ১৪ কিলোমিটার দূরে। তরুণ-তরুণীদের উদ্যম নাচ ও স্বচ্ছ জলের মধ্যে রোদের লুকোচুরি ফেলে আসতে মন চাচ্ছিল না। উঠতেই শামীম ভাইয়ের দু’হাতে লাঠি ভর দিয়ে বুড়ো মানুষের মতো হাঁটার দৃশ্য এবং কালাম ভাই ও দিলীপ দা’র স্থানীয় খেলনা তরবারি নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার দৃশ্য উপভোগ করলাম সবাই। শাওন ভাইয়ের সাথে এতোগুলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠার হাঁপানি পাহাড়ি লেবু আর নুনের শরবতে চুমুক দিতেই বন্ধ হয়ে গেল।
লাঞ্চটা সেরে নেয়া হলো এখানেই। রাচির সব রেস্টুরেন্টে এক প্লেটেই ভাত, সবজি ও অন্যান্য তরকারি রাখার ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। টাটাস্যুমো আবারো ছুটে চলেছে সাদা ও গোলাপী রংয়ের বুনো ফুটুস ফুলের অভ্যর্থনায় পাহাড়ের বুক চিরে মসৃণ পথে। গন্তব্য জোনহা জলপ্রপাত। দু’ধারে লাল লাল বসতি। ছাগল ও শুকর চরানো, ধান ও কলাই ঝাড়া সবতো মেয়েরাই করে। শরতের কাশফুল আর পাহাড়ের গম্ভীরতা- কি ¯িœগ্ধ জীবনধারা বেদিয়া আদিবাসীদের। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকা ডাগর ডাগর চোখের নাম না জানা শিশুটির ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য টেনে হিছড়ে হৃদয় থেকে বের করতে চাইলেও পারা যাবে না, এটা নিশ্চিত।
কিছুক্ষণের মধ্যে জোনহা জলপ্রপাতে পৌঁছে গেলাম। এই জলপ্রপাতের বিস্তীর্ণ জলরাশি চিত্ত দুলিয়ে এ পাথর সে পাথরের ফাক গলিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে চলেছে। পাহাড় স্নানের লোভ সামলাতে না পেরে বাবু ভাই ও জিল্লু ভাই কিছুক্ষণের মধ্যে দুরন্ত ¯স্রোতের সাথে মিশে গেলেন। আর সবাই পা চুবিয়েই স্নানেরসাধ পেতে চাইলেন। এটা ভিন্ন পথ। জোনা গেট দিয়ে প্রায় পাঁচশ’ সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে পাতালপুরীর দেশে। গৌতমধারী নদী পাঁচটি প্রবাহে পাথরের ফাক গলিয়ে আছড়ে পড়ছে দেড়শ’ ফুট নিচে। সাথে মারাত্মক গর্জন। মাঝে মাঝে মনে হয়, জলপ্রপাত হলো পাহাড়ের কান্না। সেই জলপ্রপাতের কণাসমূহ মুক্তির আনন্দে সাতরঙে মিশে হেলে-দুলে চিংড়ির মতো ছটকায়। কিনারায় দেখা মিললো ধ্যানস্থ আঙ্গিকে অতি পরিচিত বুদ্ধ মূর্তির। হিন্দি, রাজ্যের প্রধান ভাষা হলেও স্থানীয়রা আংগিকা ও নাগপুরী ভাষায় কথা বলে। নাগপুরী ভাষার খুবই জনপ্রিয় একটি গানের সুরে তরুণ-তরুণীদের নাচের তাল দেখে আমারও নাচতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। ফিরতি পথে রাস্তার ধারে শতবর্ষী আম গাছ দেখে যশোর-বেনাপোল সড়কের কথা মনে পড়ে গেল। দলের কনিষ্ঠতম সদস্য মধু, শাওন ভাই ও শামীম ভাই কয়েকটি কৌতুক শোনালো। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম।
ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আবারও রাচির দর্শনীয় স্থান দেখতে বের হতে হলো। নাস্তার জন্য তোষা, ইটলি, গুগনি ও তড়কা হাজির। নামের কি বাহার! তবে রেস্টুরেন্ট মালিকের মানবতার প্রমাণ মেলে, যখন তিনি তেলমুক্ত পিঠা আনতে বললেন, এসবে আমার সমস্যা হয় জেনে। এসব রেস্টুরেন্টে অসংখ্য পরিচারিকা কাজ করে। শুধু রেস্টুরেন্ট কেন, হাল্কা কাজগুলো তো এ রাজ্যে মেয়েরাই করছে। গেঞ্জি ও প্যান্ট অথবা টপস ও স্কার্ট পরে কোন মেয়ে এদেশে কোথাও বের হলে কি পরিমান লোলুপ চোখের শিকার হতে হয়, তা ভুক্তভোগীরাই জানে। ভাল লাগলো দেখে, মেয়েরাই বাইক, বাই-সাইকেল অথবা প্রাইভেটকার চালিয়ে দিব্যি নিজেদের কাজ করে চলেছে। কবে যে আমরাও দেশের এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব? এক্ষেত্রে আমাদের দেশের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও উদার হতে হবে। তবে সব আনন্দ ও দিনের উদ্যম উবে গেল কামলা হাট দেখে। মোরাবাদি নামক তিন রাস্তার একটি মোড়ে হাট বসেছে কামলা খাটা মানুষের। ওরা ভিক্ষা চায় না, চায় না কারো করুণা। ওরা কাজ চায়। সভ্যতার পাদপ্রদীপে থাকা এ পৃথিবীতে নুন-ভাত যোগাড় করতে এখনো মানুষকে সারাটাদিনই দাস হয়ে থাকতে হয়।
গাড়ি যেয়ে থামল পাহাড়ি টিলার একটি বাংলোর সামনে। টেগোর হিল নামটা শুনতেই মনে হলো ঠাকুর হিল নাতো? ঠিক তাই। ঝাড়খ-ের মাঝে এক চিলতে বাংলা। দেখে আরো ভালো লাগলো, এখাতে খুদিত আছে, রাচিবাসী সৌভাগ্যবান। কারণ এখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মত একজন গুণী ব্যক্তি বসবাস করতেন। কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য রচনা শুরু করেছিলেন এই টেগোর হিলের বাংলোতে বসে।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে সুরকার, গীতিকার ও নাট্যকার ছিলেন। ‘জীবিত ও মৃত’ ছোট গল্পে রবি ঠাকুরের সেই মহান উক্তি,‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই-’ শোনেন নাই, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেকে মনে করেন, এই কাদম্বরী দেবীই কাদম্বিনি। তিনি অল্প বয়সেই আত্মহত্যা করেন।
জ্যেতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর জাহাজ ব্যবসায় লোকসান গুনে ভেঙে পড়েন। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা তাকে জাগতিক মোহ থেকে টেনে নিয়ে যায় পাহাড়ি নির্জনতায়। বাংলোর মুখেই দু’নারী মূর্তি মনকে প্রফুল্ল করে দেয়। পেছনে বসে পরম মমতায় এক নারী আরেক নারীর মাথায় তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টেগোর হিলের সৌন্দর্য দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে।
পরের যাত্রা রাচির রক গার্ডেন। রুক্ষ পরিবেশে পাহাড়ি উদ্যান। বুনো লাল বাঁশ এই প্রথম দেখলাম। পাথুরে টিলার ওপরে বেশ উঁচুতে অবস্থিত রক গার্ডেনের নীচেই বিশাল জলাশয়। গ পাহাড় ও ক্যাকে ডামের মাঝে অবস্থিত রক গার্ডেনে পাথরের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পিরামিত মিউজিয়ামে যাওয়া হলো না। বিব্রত হতে হয়, কপোত-কপোতীদের খোলামেলা শরীর স্পর্শ করা দেখে।
পাহাড়ের বুক চিরে আবারো ছুটে চলা। যতদূর চোখ যায় ছোট-বড় সবুজ পাহাড়। নীল আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। দুই লেনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা থোকা থোকা ফুলের গাছ মনকে আরো সতেজ করে দেয়। এযেন আরেক দার্জিলিং। উদ্দেশ্য পাত্রাতু লেক। একশ’ পঞ্চাশ ফুট গভীর লেকের মাঝখানে দ্বীপ। সেখানে পৌঁছাতে দুই নৌকায় আমরা বারো জন। মিনি ভাই ও কুদ্দুস ভাই সেলফি তুলতে মনোযোগী হলেন। মাঝি ইমতিয়াজ আনসারি যখন জানালেন, সম্প্রতি লেক থেকে দু’মণ পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা মাছ ধরা হয়েছে, সবার চোখ কপালে উঠল।
ফিরে এসেছি আবার রাচিতে, এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাগলাগারদ দেখতে। সালমান খান অভিনীত সিনেমা ‘তেরা নাম’ এর একটি অংশ শ্যূটিং হয়েছে এখানে। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন প্রায় দেড় হাজারের মত মানসিক রোগী এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আশেক ভাই জানালেন, দেয়ালের গায়ে ঝুলানো ছবিটি বিরসা মুদ্রার। বিরসা মুদ্রা রাচি অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আদিবাসী মুদ্রাদের সংগঠিত করেছিলেন। বিদ্রোহের পর বিরসা তার অনেক সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার হন। প্রহসনমূলক বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়। মুদ্রাদের কাছে তিনি এখনও বিরসা ভগবান বলে পূজিত হন।
গাড়ি চালক প্রখ্যাত ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনীর বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। এবার আমাদের যাত্রা রাচির জগন্নাথ মন্দির। এ মন্দিরটি পুরির জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি। পাহাড়ি টিলার ওপর স্থাপিত মন্দির থেকে পুরো শহর দেখা যায়। মন্দিরের পুরোহিতের নিকট থেকে প্রসাদ নেয়ার সময় দিলীপ দা’র মধ্যে আধ্যাত্মিক অনূভুতি কাজ করছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। লাল সালাম দিয়ে সূর্য ধীরে ধীরে কালের অতল গহবরে হারিয়ে গেল। আমাদেরও বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠল। রাতের ট্রেনেই কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা। ট্রেন চলা শুরু করলো। পেছনে পড়ে রইল পাহাড়, জঙ্গল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাচি।
শারদীয়া দুর্গাপূজায় কলকাতা মহাব্যস্ত। কেউা কেনা-কাটায় আবার কেউবা চিকিৎসায় দিনটা পার করলেন। আমরা কয়েকজন কলকাতা মিউজিয়ামে গেলাম। মোস্তাফিজ ভাই অসুস্থ অবস্থায় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তবুও তিনি সবাইকে ভালোই সঙ্গ দিলেন। বিকেলে অনেকে থিয়েটার দেখে মুগ্ধ হলেন।
পরের দিন ইছামতির টাকিতে যখন এসে পৌঁছালাম, বেলা তখন প্রায় এগারটা। বিজয়া দশমীতে ইছামতি নদীতে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষ্যে দু’বাংলার যে মিলন মেলা বসে। সেখানে অনেকবার গিয়েছি। তখন খুব ইচ্ছে হতো, ওপারে যাওয়ার। বহুদিন পরে সে সাধ পূর্ণ হলো। টাকির জমিদার স্যার কালিনাথ মুন্সির বাড়িতে যাওয়া হলো। এখানে ‘শঙ্খচিল’ সিনেমার কিছু অংশ শ্যূটিং হয়েছে। আর একটু সামনে গেলেই নদীর এপারে দেবহাটার ইকো-ট্যুরিজম স্পট চোখে পড়ে।
তবে টাকি থেকে বিদায় এতো যে বিষাদময় হবে, কে তা জানতো। এখানেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন, শহীদ নাজমুল সরণির নাজমুল। পলাশপোলের তরুণ ছাত্র নাজমুল হক দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করতে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। টাকির প্রথম যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তাকে সমাহিত করা হয় বর্তমান স্যার কালিনাথ মুন্সি পর্যটন সেন্টারের পাশে ইছামতির তীরে। স্থানীয় লোকদের মনে নেই নাজমুলের কথা। হতাশ হয়ে বিড়বিড় করে বলে ফেল্লাম, স্বাধীন বাংলার ইছামতির উচ্ছ্বল জল, প্রতিদিন তোমাকে নাইয়ে দেয়, এটাই সান্ত্বনা।
ভ্রমণ কথা:পাহাড়, জলপ্রপাত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাচিতে আমরা ১২জন
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/