Site icon suprovatsatkhira.com

কর্মশালায় নিউজ নেটওয়ার্কের তথ্য: বিশ্বে দশ বছরে ৭৫১ সাংবাদিক খুন

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘মেক মিডিয়া ফ্রি, জিডিপি উইল ইনক্রিস অ্যাট লিস্ট টু পার্সেন্ট’ নোবেল বিজয়ী ড. অমর্ত্য সেনের এই উক্তিকে সামনে রেখে সাতক্ষীরায় পত্রিকার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় বক্তারা বলেন, সাংবাদিকতায় নিহিত রয়েছে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সুশাসন, গণতন্ত্রকে শাণিত করাসহ নানা উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ফ্রিডম অব প্রেস এখন এক চলমান আন্দোলন।
এ প্রসঙ্গে বক্তারা আরও বলেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া ওয়াচ ডগের ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা গেইটকিপার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছে। এ জন্য সাংবাদিক ও মিডিয়া গেইটকিপারদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। এর সাথে সাথে নারী সাংবাদিকতাকে জোরদার করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
বুধবার সকালে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শহিদ স ম আলাউদ্দিন মিলনায়তনে সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ও সাপ্তাহিকের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে ‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দায়মুক্তি বিষয়ক কর্মশালায় আয়োজকরা এসব কথা তুলে ধরেন।
এতে তারা আরও বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি যথাযথভাবে মোকাবেলা করা গেলে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত হবে। দেশ আরও সমৃদ্ধ হবে। অচিরেই বাংলাদেশ এমন একটি জায়গায় পৌঁছাতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
সাংবাদিকরা বহুমুখী নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে দায়িত্ব পালন করছেন উল্লেখ করে তারা বলেন, এই পেশা ঝুঁকির পেশা। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তারা বলেন, ২০১৫ সালে বিশ্বে ৭১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ৩ জন সাংবাদিক। এর আগে ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৬৮০ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে বিচার হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশের। বাকি ৯৪ শতাংশ হত্যাকা- দায়মুক্তির পর্যায়ে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
সাংবাদিক হত্যা এবং তার বিচার না হওয়ার যে সংস্কৃতি বহমান তা থেকে বেরিয়ে আসতে কাজ করছে নিউজ নেটওয়ার্কসহ বহু সংগঠন।
নিউজ নেটওয়ার্কের সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক শহীদুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হোসেন বকুল। এ সময় নিউজ নেটওয়ার্কের মনিটরিং অফিসার শ্যামল সিংহ রায় এবং সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়কারী এম কামরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে আলোচকরা বলেন, এই ঝুঁকি রাজধানী ঢাকায় অপেক্ষাকৃত কম হলেও ঢাকার বাইরে তা অনেক বেশি। হত্যা, হত্যার হুমকি, মানসিক চাপ, শারীরিক আঘাত, হামলা ও মামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে উল্লেখ করে তারা বলেন, সরকার ও প্রশাসনের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বললেই এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশ যতোই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই হত্যা হুমকি ও ঝুঁকি বাড়ছে বলেও উল্লেখ করা হয় কর্মশালায়। এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের বলে উল্লেখ করেন তারা।
কর্মশালায় তারা বলেন, মিডিয়ার কাজ কোনো উন্নয়ন বন্ধ করা নয়, মিডিয়ার কাজ কোনো গণমুখী কর্মকান্ডে বাধা দান নয়, কাউকে নিরুৎসাহিত করা নয়। বরং মিডিয়ার কাজ সবকিছু জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা। নিয়মতান্ত্রিকতা নিশ্চিত করা। এ প্রসঙ্গে তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখ-তা ছাড়াও জাতীয় সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ নানা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে বলেন, এসব যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
একজন সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। তাকে আটক করা, কারাগারে নিক্ষেপ করা, তার দেহ তল্লাশি করা, তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া, দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া, তার রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া, দুর্নীতিবাজ বা পাচারকারীদের হামলার শিকার হওয়া এমনকি নানাভাবে প্রলুব্ধ হবারও ঝুঁকি রয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে, বিক্ষোভ মিছিলে, আন্দোলনে, সহিংসতার সময় তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার ধরন পরিবর্তিত হতে পারে জানিয়ে তারা বলেন, এমনকি একজন সাংবাদিকের সংবাদ বিষয়ক উপকরণ চুরি ও তা বাজেয়াপ্ত হতে পারে। তিনি ডিজিটাল হুমকি, লিখিত হুমকি এমনকি তিনি সন্ত্রাসী অথবা আইনশৃংখলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও পড়তে পারেন। সংবাদপত্রে অগ্নিসংযোগ, সংবাদপত্র ভবনে হামলা, ভাঙচুর, ব্যবহার্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত, মাঠ পর্যায়ে ক্যামেরা ভাঙা, ই-মেইল, ফেসবুক এবং অনলাইনে ট্রলসের মাধ্যমেও তিনি হুমকির মধ্যে পড়তে পারেন। সর্বত্র ডিজিটাল হয়রানি, সহিংস হামলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা বিষয়ে একজন সংবাদকর্মী বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আলোচক বক্তারা মিডিয়া ও গেটকিপারদের নিরাপত্তার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
রাজধানী ঢাকার বাইরে সাংবাদিকরা কেন বেশি ঝুঁকির মধ্যে এমন প্রশ্নের উত্তরে নিউজ নেটওয়ার্ক সম্পাদক শহীদুজ্জামান বলেন, সচরাচর ‘ভেস্টেট কোয়ার্টার’ (পরিত্যক্ত ভবন) এর লোকজন এই সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোট ছোট শহরে সাংবাদিকরা নীতিগত বিষয়ে অনেকটা পশ্চাদপদ। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যাও কম। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধও আছে। এসব কারণে চোরাচালানি, পাচারকারী এবং ডগলর্ডদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ঢাকা হাউজ থেকে নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা না করাও এধরনের হামলার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়।
বক্তারা বলেন, সাংবাদিকতায় নৈতিক চর্চা বাড়াতে হবে, রিপোর্টিংয়ে বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে হবে এবং সম্পাদনার ক্ষেত্রে পক্ষপাতহীনতার গুরুত্ব দিতে হবে। নির্বাহী সম্পাদক ও সহ-সম্পাদককে গেইটকিপারের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনটি করা গেলে ঝুঁকি অনেকটাই প্রশমিত হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তারা।
কোন ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা নিয়ে রিপোর্টিংয়ের সময় সংবাদকর্মীদের গ্রুপগতভাবে কাজ করানো, তথ্য বিনিময়ের সুযোগ থাকা এবং শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্তদের রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আলোচকরা আরও বলেন, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বিশ্বে ৫৯৩ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ১২৩ জন এবং ২০১৩ সালে ৯৩ জনকে হত্যা করা হয় জানিয়ে আয়োজকরা আরও বলেন, প্রতি ১০টি কেসের মধ্যে ৯টিই অনিষ্পত্তিকৃত রয়ে গেছে। এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এ ধরনের ৬০ শতাংশ ঘটনার বিচার হয়নি। তারা ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে) এর পরিসংখ্যান তুলে ধরে আরও বলেন, গত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। এ অবস্থা থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে হলে তাদের নতুন পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ঝুঁকি প্রশমনে নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না মন্তব্য করে কর্মশালার সভাপতি শহীদুজ্জামান বলেন, নিউজ নেটওয়ার্ক ১৯৯৮ সাল থেকে নারী সাংবাদিকদের ট্রেনিং করিয়ে ফেলোশিপ দিয়ে আসছে। ১৪ বছরে ৩৫০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা এখন বড় বড় মিডিয়া হাউজের প্রতিনিধিত্ব করেন। অনেকে বিদেশে পিএইচডি করছেন এবং অনেকে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকতায় খ্যাতি লাভ করেছেন। নারী সাংবাদিকদের নিরাপদে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তারা বলেন, তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হলে অন্যদের তুলনায় তারা ভালো কাজ দেখাতে পারেন। পেশাগত দক্ষতার ফলে তারা সর্বোচ্চ সফলতা দেখাতে পেরেছেন। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়াশিংটন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন এবং ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত লন্ডন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সেফটির তথ্য তুলে ধরে তারা বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৯৭৭জন নারী সাংবাদিক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ নারী তার অফিস বস, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অথবা সহকর্মীর যৌন হয়রানির মুখে পড়েছেন। তারা মিডিয়া হাউসের বাইরের চেয়ে ভেতরে বেশি হয়রানির মধ্যে রয়েছেন। এর মধ্যে ৬০ ভাগ তার বস দ্বারা এবং ৪০ ভাগ অন্যদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন তারা।
নারী সাংবাদিকদের ৪৬ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয়েছেন জানিয়ে তারা বলেন, এরই মধ্যে বলিউড থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ‘মি টুু’ আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে তারা ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দ্য এশিয়ান এজ এর প্রাক্তন সম্পাদক এমজে আকবরের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, যৌন হয়রানির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তবে পরে তিনি কয়েকজন নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। অপরদিকে কমপক্ষে ২০ জন নারী সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ‘মি টু’ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
দুদিনের এই কর্মশালায় যোগ দেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি ও দৈনিক কালের চিত্র সম্পাদক অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভির সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহি, দৈনিক পত্রদূতের উপদেষ্টা সম্পাদক আনিসুর রহিম, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী, পত্রদূতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লায়লা পারভিন সেঁজুতি, দৈনিক দৃষ্টিপাত’র নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরার নির্বাহী সম্পাদক তানজির কচি, সাপ্তাহিক সূর্যের আলো সম্পাদক আবদুল ওয়ারেশ খান চৌধুরী, ডেইলি সাতক্ষীরার সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম প্রমুখ।
কর্মশালায় সাংবাদিকতা পেশায় নারী সাংবাদিকদের আগ্রহী করে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়, এ জন্য সম্পাদকরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা তাদের উৎসাহিত করলে নারী সাংবাদিকতা আরও বেগবান হতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন আলোচকরা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version