Site icon suprovatsatkhira.com

যেভাবে উত্থান-পতন ডাকাত সর্দার খুনে জলিলের

ডেস্ক রিপোর্ট: এতোদিন মুখ চেপে ছিলেন কয়েকজন নারী। প্রকাশের কোনো ভাষা কিংবা সামাজিক শক্তিও ছিল না তাদের। তবে ডাকাত সর্দার জলিলকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জনতা গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছে এমন খবর পেতেই যেনো তাদের মুখ ফুটলো। ভয়ংকর খুনি জলিলের বিকৃত লাশে কেউ থুথু ফেললেন। কেউ লাথি মেরে ঘৃণা প্রকাশ করলেন।
শনিবার রাতে ঠিক এমন দৃশ্যই দেখা গেলো কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগরে। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তা প্রত্যক্ষ করলেন।
এ জলিল সেই জলিল যার ছিল একটি ডাকাত বাহিনী। তাদের সর্দার সে। কখনও জাতীয় পার্টি, কখনও জামায়াত, কখনও বিএনপি করে এখন সেই জলিল আওয়ামী লীগের ছায়াতলে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো দলই তাকে রক্ষা করতে এলো না। বরং মড়ার ওপর এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললো ‘জলিলদের মতো মানুষের জন্য এই শাস্তিই অপেক্ষা করছিল’।
জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের ইয়াকুব আলি গাইনের ছেলে জলিল গাইন। দরিদ্র দিন মজুর থেকে জলিল এখন আশি লাখ টাকার আলিশান বাড়ির মালিক, যে বাড়িতে রয়েছে ১৭টি সোলার ও একটি এসি। শনিবার রাতে জলিলের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করেছে। তারা তাকে সাতক্ষীরার দ্বিতীয় ‘এরশাদ শিকদার’ নাম দিয়েছে। ডাকাতি করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে ডাকাত সর্দার জলিল গাইন। সেসব নারী ও তাদের পরিবার এ ঘটনা চেপে রেখে মামলা করার সাহস পায়নি। তবে জলিলের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করার পর তারা পুলিশকে বারবার টেলিফোন করে জানিয়েছেন। কান্নাকাটি করেছেন। নিজেদের অব্যক্ত কষ্টের কথা বলেও শেষ হাসি হেসেছেন জলিলের শোচনীয় পরিণতিতে।
২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগরের কৃষক মাজেদ পাড় হত্যার মধ্য দিয়ে তার উত্থান। তারপর একে একে ডাকাতি রাহাজানি করে নিজেকে অপরাধ জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে এই জলিল। এরই মধ্যে একটি গণধর্ষণে অংশ নেয় জলিল। তার এলাকার ফজলু ডাকাত, ফজর ডাকাত, বারী ডাকাত, আজিজ ডাকাত, মাজেদ ডাকাত, ঘুঘু ডাকাত, রেজাউল ডাকাত, নুরুল ডাকাত, কালাম ডাকাত, জিয়া ডাকাত, ইসলাম ডাকাত, আলেক ডাকাত, এরশাদ ডাকাত, আশাফুর ডাকাত, মোস্তাপ ডাকাত, ডাকাত ইয়ার আলি, ডাকাত বাহার আলি, রনজিত ডাকাত, মজিদ ডাকাত, রবি ডাকাত, সিরাজ ডাকাত, আবদুল ডাকাত (নিহত), মতলেব ডাকাত (নিহত) সবাই ছিল জলিলের অনুগত। দুই ডাকাত আবদুল ও মতলেব অন্যান্য ডাকাতদের কোপানলে পড়ে খুন হয়েছিল। এর সাথে জড়িত ছিল ডাকাত সর্দার জলিল। এর আগে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে কৃষ্ণনগরের ডাকাতদের মধ্যে প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে বিরোধ বাঁধে। এ সময় কয়েকচন ডাকাত আহত হয়ে কেউ পা হারায়, কেউ হাত হারায়। কারও কারও দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আবার বিস্ফোরণে কোনো কোনো ডাকাতের দেহের অঙ্গ উড়ে যায়। জলিল এসব ডাকাতদের সহযোগী হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। সর্বশেষ সে ছিল ডাকাত দলটির সর্দার। রাতের আাঁধারে তার ভয়াল মূর্তি নিরীহ গ্রামবাসীকে আতংকিত করে তুলতো। তার কাছে ছিল একাধিক বেআইনি অস্ত্র। থাকতো বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। এতো অপরাধের পরও মানুষ তাকে ভোট দিয়ে ২০১৬ সালে ইউপি সদস্য বানিয়েছিল। এখন পর্যন্ত জলিলের বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ১২টি বিভিন্ন অপরাধের মামলার খতিয়ান খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।
২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে আশাশুনির গৃহবধূ সাজেদা খাতুনের দুটি গরু চুরি করে জলিল গাইন। ২০০৭ সালের ২৩ মে তারিখে সাতক্ষীরা শহরের অদূরে বাঁকাল এলাকায় একটি ওয়ান শ্যুটার গান, একটি পাইপ গান ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ পুলিশের হাতে আটক হয় জলিল। ২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কৃষ্ণনগর বাজারের আল্লার দান জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি করে জলিল গাইন। ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর চাঁদাবাজির মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। জলিল এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাত লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। জলিল খুলনা এবং শ্যামনগরে আরও একটি করে দুটি খুন করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সেসব খুন সংক্রান্ত কাগজপত্র অচিরেই পুলিশের হাতে আসবে বলে জানান ওসি হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, জলিলের অপরাধের অন্ত নেই। মামলাও অনেক।
কালিগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের। সর্দার জলিল এসব ঘেরে প্রায়ই তার বাহিনী নিয়ে ডাকাতি করতো। কোনো ঘের দখলের বিষয় থাকলে সে তার ডাকাত বাহিনী নিয়ে ঝাঁপ দিতো। সে ভাড়াটে খুনি হিসাবে এলাকার বাইরে যেতো। কয়েকদিন পর ফিরে আসতো। জলিল যার দল করতো তার সাথে গড়ে তুলতো দহরম মহরম। ২০১৬ সালেও জলিল করতো বিএনপি। সে সময় তার নেতা কাশিমাড়ির ওলিউর রহমান ওরফে ওলি মোল্লাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল সে। ব্যর্থ হয়ে সে পুলিশকে গোপন তথ্য দিয়েছিল। পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ওলি। জলিল ডাকাত এঘটনা ঘটাতে গোপনে একটি মহলের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল বলে দাবি ওলি পরিবারের। জলিলের এক সময়কার দল জাতীয় পার্টির জেলা পর্যায়ের নেতা কেএম মোশাররফ হোসেনের সাথে খুব মেলামেশা করে ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত সেই মোশাররফ হোসেনকে জলিল ও তার সহযোগীরা গত ৮ সেপ্টেম্বর গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। সে নিজের ভোল পাল্টিয়ে এক এক সময় এক একজন রাজনৈতিক নেতার কাছাকাছি চলে যেতো। আবার তারই সর্বনাশ করতো জলিল। তবে কৃষক মাজেদ পাড় হত্যাসহ অন্যান্য মামলায় জলিল যার হাত ধরে রক্ষা পেয়েছিল সেই প্রাক্তন জনপ্রতিনিধি এখন জলিলকে গণপিটুনিতে হত্যার কাজে সহযোগিতা দেওয়ায় পুলিশ ও কৃষ্ণনগরের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমনকি ফুলের মঞ্চ তৈরি করে তিনি তাদের সংবর্ধনা দিতে ঢাকা থেকে এখন এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি এর আগে জলিলের সব অপকর্মকে ধামাচাপা দিয়েছেন। নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত এই নেতা এখন এলাকায় এসে মোশাররফ হত্যাকে পুঁজি করে এবং জলিলের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার চেষ্টা করছেন। অথচ তিনি জলিলের অপরাধ উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।
তবে, স্থানীয়দের দাবি,খুনে জলিল সর্বশেষ কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে যাবতীয় অপকর্ম চালিয়ে যেত। ওই নেতার হাত ধরে তরুণ লীগের ফ্যাটো লাগিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করেছে সে। যদিও চেয়ারম্যান মোশাররফ হত্যা ও তার পরবর্তী সব ঘটনায় নিশ্চুপ তিনি।
নাম পরিচয় প্রকাশ না করেই গ্রামের কয়েকজন নারী বলেন, জলিলের কারণে রাতে নারীরা আতংকের মধ্যে ধাকতেন। বিশেষ করে পুরুষ লোক বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে নানা অছিলায় বাড়িতে ঢুকে পড়তো খুনে জলিল। তারপর নারীরা হতেন ধর্ষণের শিকার। এমন কমপক্ষে ৪০টি ঘটনার সাক্ষীরাই শনিবার রাতে ডাকাত সর্দার খুনে জলিলের গায়ে থু থু দিয়েছেন।
নিজের ছবিই কাল হলো জলিলের
গত ৮ সেপ্টেম্বর নৃশংস হত্যার শিকার হন কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগর ইউপির তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাপা নেতা কেএম মোশাররফ হোসেন। এই হত্যার প্রধান আসামি আবদুল জলিল গাইন ওরফে জলিল ডাকাত ওরফে খুনে জলিল পালিয়ে যায়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর তার ছবিসহ জাতীয় দৈনিকে ‘দিন মজুর থেকে খুনে জলিল’ শীর্ষক একটি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ছাপা হয়। শুক্রবার রাতে এই ছবি দেখে গাজিপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার একটি মাকের্টের লোকজন জলিলকে শনাক্ত করেন। তারাই জলিলকে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন। এরপর শনিবার বিকালে তাকে নিয়ে আসা হয় সাতক্ষীরায়। রাত পৌনে ৯টায় তাকে নিয়ে তার নিজ এলাকা কৃষ্ণনগরে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় জনতা। এরপরই গণপিটুনিতে নিহত হয় জলিল।
নিহত জলিলের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। গণপিটুনি দিয়ে তাকে হত্যার দায়ে অজ্ঞাতনামা ৫ থেকে ৬ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কালিগঞ্জ থানায়। এ ঘটনায় বাধা দিতে গিয়ে তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি পুলিশের।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version