মো. আব্দুল কাদের
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ভাষায়, “বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে”- যদিও কবি আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই কিন্তু তার স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। বিদ্রোহী কবির কল্পনার সুফল আমরা ভোগ করছি। ছোট্ট একটা মুঠো ফোনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের আলাপচারিতা, লেনদেন, কেনাকাটা, চিত্তবিনোদন, অফিস কর্ম (ই-নথির মাধ্যমে), খেলাধূলা, সংবাদ শোনা, লেখাপড়া এক কথায় নিত্যদিনের অনেক কাজই আমরা ছোট্ট একটা মুঠো ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন করছি। এখন আমরা দেখবো উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কতটুকু সামনে অগ্রসর হচ্ছি? কোথায় আমাদের অবস্থান? আমাদের নতুন প্রজন্ম কিভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে?
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বি.টি.আর.সি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত চার বছরে দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে চার কোটি ৯৮ লাখ ৬৬ হাজার ৭৪৯ জন। ২০১৪ সালের জুন মাসে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৭৯ লাখ ২৩ হাজার ২৫১ জন। আর ২০১৮ সালের জুনে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ। অথচ ২০০৮ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন মাসে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ তিন হাজার ৩১ জন। আর ২০১৮ সালে এসে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৬ লাখ ৮৫ হাজার। অবশ্য ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আইএসপিএবি সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক কোটি।
তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের সাফল্য: বিগত ৬ বছরে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (www.bangladesh.gov.bd) বিশ্বের বড় ওয়েব সাইটগুলোর অন্যতম। এখানে রয়েছে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ৩৫৩ অধিদপ্তর ও অন্যান্য, ৮টি বিভাগ, ৬৮ জেলা, ৪৯১টি উপজেলা, ৪৫৫৪টি ইউনিয়ন এর বিশাল তথ্য ভণ্ডার। এক কথায় বাংলাদেশ সম্পর্কিত সকল তথ্য এখানে পাওয়া যাবে। তাছাড়া ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো এরূপ-
ক) শিক্ষা ক্ষেত্রে- তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। ই-বুক, ই-কন্টেন্ট, অনলাইন প্রশিক্ষণ, অনলাইন ভর্তির আবেদন, অনলাইন পরীক্ষা, অনলাইন ক্লাস (টেন মিনিট স্কুল, বিডি পাঠশালা, মুক্তপাঠ), মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ নানা সংযোজন শিক্ষা কার্যক্রমকে করেছে গতিশীল।
খ) ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রে- তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যবসা বাণিজ্যকে করেছে অধিক গতিশীল। এখন গ্রামের একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানদারকে আর সেজেগুজে টাকা নিয়ে শহরে যেতে হয় না মাল কিনতে। সে এখন মোবাইল ফোনে অর্ডার দেয় আর টাকা পাঠায় রকেট কিংবা বিকাশ এর মাধ্যমে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার দোকানে মালপত্র এসে হাজির হয়। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে অনলাইনে কেনাকাটা।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-ক্যাব সূত্র জানায়, গত ঈদুল ফিতরে অনলাইনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেচা-কেনা হয়। গত বছর যা ছিল একশ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে উৎসবকে কন্দ্রে করে অনলাইনে বেচা-কেনার পরিমাণ প্রায় তিন গুণ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার কেনার অর্ডার আসছে অনলাইনে। ডেলিভারিও হচ্ছে প্রায় সমপরিমাণ। পণ্য হাতে পাওয়ার পর তা পছন্দ না হলে সহজে তা পরিবর্তনের সুযোগ থাকায় আগের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অনলাইনে কেনাকাটা। এমনইভাবে ই-কমার্স, ই-পেমেন্টসহ নানাবিধ প্রযুক্তির সংযোজন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রকে করেছে দিগন্ত প্রসারী ।
গ) চিকিৎসা ক্ষেত্রে- বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসা ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। অনলাইনে রোগী দেখা, অনলাইনে রোগীর সিরিয়াল নেয়া, বিদেশী ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ, পরামর্শ, সর্বোপরি টেলিমেডিসিন চিকিৎসা কার্যক্রমকে করেছে গতিশীল। হার্ট অপারেশন, ক্যান্সারসহ অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে সুন্দর এবং সফলভাবে হচ্ছে।
ঘ) অনলাইন আয়ের ক্ষেত্রে- বর্তমানে দেশে প্রায় ৬০ হাজার ফ্রিল্যান্সার তথ্যপ্রযুক্তি বাজারে নিয়মিত সক্রিয়। অনিয়মিত ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা আরও প্রায় ৭৫ হাজার। সরকারের পরকিল্পনা রয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পেশাজীবী ২০ লাখে উন্নীত করার। এ ছাড়া বর্তমানে জাপান, কানাডাসহ বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে সফটওয়্যার রফতানি করছে বাংলাদেশ। বিশেষত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ডাটা সফটের জাপানে স্মার্ট ভবন প্রযুক্তি বাস্তবায়ন দেশের জন্য বড় গৌরব বয়ে এনেছে। ২০২১ সালের মধ্যে সফটওয়্যার থেকে এক বিলিয়ান ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঙ) জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট র্যাঙ্কিংয়ে ১১৫তম বাংলাদেশ- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিগত ৬ বছরে আশানুরূপ ব্যাপক উন্নয়নের ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতিসংঘের ই-গভর্নমন্টে জরিপে ১৫০তম স্থান থেকে নেমে ১১৫তম অবস্থান র্অজন করেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ (ইউএনডেসা) পরিচালিত ই-সরকার ডেভেলেপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই) অনুযায়ী, বাংলাদেশ ০.৪৭৬৩ পয়েন্ট পেয়ে এবং গত দুই জরিপে ৩৫ ধাপ এগিয়ে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থানে অবস্থান করে নিয়েছে। যা ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৪তম, ২০১৪ সালে ১৪৮তম এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫০তম। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, শেখ হাসিনার সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নানান উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ দিন দিন অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। মানবসম্পদ সূচক এবং টেলিকমিউনিকেশন সূচককে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি এবং ডাটার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সিআরভিএস ওপেন ডাটা পোর্টাল, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, এসডিজি পোর্টাল, বিগ ডাটা উদ্যোগ ইত্যাদিসহ নানান প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে যা বাস্তবায়িত হলে অনলাইন সার্ভিস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরো ভাল হবে।
বাংলাদেশ ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সর্ম্পূণরূপে একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই দেশটির ২০০৯ থেকে ২০১৮ এর মধ্যে যে রূপান্তর, যা বিশ্ব মানচিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে তা অভিনন্দনযোগ্য। এজন্য আমাদের নিজেদের কাজ করতে হয়েছে এবং পাশাপাশি পৃথিবীকে জানাতেও হয়েছে যে আমরা কাজ করছি। আমাদের চারপাশে যে তথ্য উপাত্ত তার পরিপূর্ণ প্রতিফলন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়নি, সেজন্য প্রকৃত অবস্থানও নির্ধারণ করা যায়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ অতীতের চেয়ে ভাল সূচকে অবস্থান করছে। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশ কেন্দ্রিক চিন্তার দিক থেকেও সবচেয়ে সুসময়ে অবস্থান করছি আমরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে তাদের নিজেদের মধ্যে যে সংহতি তা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল। এখন তারা সমন্বিত ভাবে কাজ করছে।
সরকার ওপেন ডাটা পোর্টাল এর সাথে সাথে একটা ওপেন ডাটা পলিসি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংসদে বিবেচনাধীন রয়েছে। কয়েকটি স্বল্পোন্নত দেশের সাথে এটুআই ইতোমধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যেখানে বাংলাদশের মত করে ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা যায়।
বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ড্যাসবোর্ড তৈরি করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরি হয়েছে যা এনালগ থেকে ডিজিটাল সেবার প্রতি সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে আগ্রহী করে তুলেছে। ইউএনডেসার সহযোগিতায় সরকারি বিশাল ডাটা বা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটি ফর এসডিজি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাটা বা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সক্ষম হয়েছি। সরকারের বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে জনগণের সাথে বিভিন্ন পদ্ধতিতে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা এখন প্রযুক্তিগত কাঠামো তৈরি করতে বিভিন্ন প্রায়োগিক কৌশল প্রয়োগ করতে সক্ষমতা র্অজন করেছি।
বিগত বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় বিভিন্ন সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি সেবা ডিজিটালাইজ করার মধ্য দিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ক্রমাগত এই সফলতার ফলসরূপ বিশ্বে আইসিটি সেক্টরের সম্মান জনক পুরস্কার ‘ওর্য়াল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমশেন সোসাইটি’ সহ নানা আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল সরকারে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদে পলক এর নাম। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপলিটিক্যাল’ প্রকাশিত এই তালিকায় স্থান পান পলক। এর আগে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জুনাইদ আহমেদ পলককে ‘ইয়াং গ্লোবাল লিডার-২০১৬’ নির্বাচিত করে।
বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার: দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে মানুষের জীবন অনেক সহজ ও গতিশীল হচ্ছে- একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রতিটি বিষয়ের ভালো ও মন্দ দুটি দিকই রয়েছে। ইন্টারনেটের খারাপ দিক হলো এর অপব্যবহার।
তরুণ সমাজ তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে। কেউ যদি এগুলোতে অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং একারণে যদি তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘিœত হয়, তখনই বাঁধে সমস্যা। এর ফলে ভুক্তভোগীর পাশাপাশি সমস্যায় পড়তে হয় বন্ধু, পরিবার এবং সমাজকে। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার অনেকটা মাদকাসক্তির মতো। এতে করে স্থূলতা, ঘুম কমে যাওয়া, সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনায় বাধা, মানসিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যা দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের একজন কবি বলছেনে, ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। আজকাল বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় বসলে দেখা যায়, যে যার মতো স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাস বা ট্রেনে চলার সময় অনকেকেই দেখা যায় ফেসবুকিং বা ব্রাউজিং করে দীর্ঘ সময় পার করে। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে একটা ভালো বই পড়া যেতে পারে।
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে রেহাই দিতে তরুণদের সমাজকল্যাণ মূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খেলাধূলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া অভিভাবকরা সন্তানদের কাছে ইন্টারনেটের ভালো ও ক্ষতিকর দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। শুধু অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ না করে সন্তানদের সময় দিতে হবে। এতে তরুণ-তরুণীরা সচেতন হবে। সর্বোপরি সমাজ, পরিবার ব্যক্তি তথা সবার সচেতনতাই পারে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে। ‘মাধ্যমিকের ৮০ ভাগ শির্ক্ষাথীর হাতে ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন’ শিরোনামে একটি খবর (ইত্তফোক ১৬ জুলাই/১৮) প্রকাশিত হয়।
ঢাকা মহানগরীর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের ৮০ দশমিক ৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭২ ভাগ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক এবং ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ শিক্ষার্থীর ইউটিউব একাউন্ট আছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের গণমাধ্যম সাক্ষরতা যাচাই জরিপে এ তথ্য উঠে আসে।
সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর মিডিয়া ইন ডেভলেপমেন্ট (সাকমিড) আয়োজিত এক গোলটেবিল সভায় জানানো হয়, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য প্রযুক্তিগত সেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বিগত এক দশক ধরে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। এরই মধ্যে জনগণ তার সুফল পেতে শুরু করেছে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়িয়েছে। তবে আশংকার বিষয় হচ্ছে, আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কিশোর এবং তরুণরা কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই ইন্টারনেটের মতো ব্যাপক একটি জগতে প্রবেশ করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন না এমন মানুষ নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ধরণ ভীষণভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলাফল ইতিবাচক হলে তা জীবনমানকে উন্নত করে, অন্যথায় তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে হতাশাগ্রস্ত করে। নিজের অজান্তেই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মনন এবং মানসকিতার উপরে কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
‘ফেসবুকে নজর রাখছে ১৫০০০ ফেসবুক পুলিশ’ শিরোনামে একটি খবর সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে জানা যায়, ফেসবুকে বিশ্বজুড়ে ব্যবহারকারীদের পোস্ট করা কমন্টেগুলো নজরদারির আওতায় এনেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। আর নজরদারিতে কাজ করছে প্রায় ১৫০০০ ফেসবুক পুলিশ। কোন ফেসবুক পোস্ট আপত্তিকর, বীভৎস; বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে তা যাচাই করে মুছে দিচ্ছেন তারা। নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন ফেসবুক পুলিশ বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের দেখতে হয় এমন কিছু জিনিস, যা আমাদের আতঙ্কিত করে, স্তম্ভিত করে। মানুষের শিরচ্ছেদ, প্রাণিদের উপর অত্যাচার এইরকম নানা কিছু।’ এই ব্যাপারে ফেসবুকের কর্মকর্তা মণিকা বীর্কাট জানান, নজরদারির কাজে নিয়োজিত ফেসবুক পুলিশদের কাজটা কঠিন। তবে এর কোনো বিরূপ প্রভাব যাতে তাদের ওপর না পড়ে সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কর্তৃপক্ষই স্বীকার করেছেন যে, নেতিবাচক কনটেন্ট মানসকিতার উপর প্রভাব ফেলে। তাই ব্যক্তিগত জীবনে এর ব্যবহার সীমিত করাই উত্তম। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া দরকার। এর কুপ্রভাব সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারলেই প্রযুক্তির সুফল দেশে ও সমাজের প্রত্যকেটি স্তরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের সত্যিকার সুফল পাবেন দেশের জনগণ এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিকে সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী করার হাতিয়ার হবে সোশ্যাল মিডিয়া।
তথ্য প্রযুক্তির ভালো মন্দ উভয় দিক রয়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে স্কুলগামী ছেলে মেয়েদের হাতে ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন খুবই ক্ষতিকর। এদিকে অভিভাবকদের অধিক সচেতন হওয়া উচিত। আগামী প্রজন্ম যেন ব্লু হোয়েল বা নবাগত গেম মম’র মত ক্ষতিকর গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের জীবনকে বিসর্জন না দেয় সে দিকে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট, সেই প্রযুক্তি যেন মানব সভ্যতাকে ধ্বংস না করে। বাংলাদেশ এত অল্প সময়ে তথ্য প্রযুক্তির সকল ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এর সুফল ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সকল স্তরে, তবেই না বাস্তবায়ন হবে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প-২০২১, তথা স্বাধীনতার মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, যুগান্তর, কালের কন্ঠ, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন) লেখক: সহকারি পরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা