আরিফুল ইসলাম রোহিত: ‘আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশের, এই সমাজের নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের’- নজরুলের এই সাম্যের জয়গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাতক্ষীরায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদ্বোধন হয়েছে তিন দিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলন।
বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ উপলক্ষ্যে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়ে শহরের নিউমার্কেট, পাকাপুল হয়ে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে গিয়ে শেষ হয়। এতে সদর উপজেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে।
র্যালি শেষে শিল্পকলা একাডেমিতে বেলুন-ফেস্টুন ও কবুতর উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নিশ্চিত কুমার পোদ্দার। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, নজরুল ইনিস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা ও নজরুল ইনিস্টিটিউটের সচিব আব্দুর রহিম।
সকাল ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে কবি নজরুল ইনিস্টিটিউট ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন নজরুল গবেষক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ এফ এম হায়াতুল্লাহ। তিনি বলেন, আনন্দিত জীবন-যাপন ছাড়া যে কোন জাতি থাকে মৃত। নজরুল আমাদের তার লেখনীর মাধ্যমে আনন্দ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তাকে বুঝতে পারিনি বলে বিভিন্ন সময় অপবাদ দিয়েছি। আসলে কবি নজরুলকে বোঝা খুব একটা সহজ কাজ নয়।
হায়াতুল্লাহ নজরুলকে জাগরণী কবি বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, নজরুল ইসলাম মৃতপ্রায় জাতিকে জাগরণী কর্মের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেছেন। তবে নজরুলের কর্ম মানুষকে পৃথক করে না বরং ঐক্যবদ্ধ করে। আর এজন্য তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছেন মানবধর্মকে। তার চিন্তা চেতনায় ছিল মানবতা।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন নজরুল ইনিস্টিটিউটের সচিব আব্দুর রহিম, কবি ও সাহিত্যিক কাজী অলিউল্লাহ ও তালা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আশুতোষ সরকার।
আলোচনা সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল হান্নানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি নিশ্চিত কুমার পোদ্দার বলেন, নজরুল বেশ কষ্টসাধ্য করেই জীবন-যাপন করেছেন। প্রতিবাদী হওয়ার কারণে বারে বারে তাকে জেলে যেতে হয়েছে।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আরও বলেন, নজরুলের দূরদর্শীতা ছিল অনেক বিস্তৃত। তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমাহদেশকে নিয়ে যেসব লেখা তার রয়েছে সেখানে তিনি আজকের উন্নত বাংলাদেশেকেই বুঝিয়েছেন।
তিনি নজরুলকে সাম্যের কবি আখ্যা দিয়ে বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান তিনি তার লেখনীর মধ্যেই জানিয়েছেন। এজন্যে আমাদের জাতীয় চেতনায় নজরুলের স্থান রয়েছে।
নিশ্চিত কুমার পোদ্দার বলেন, বঙ্গবন্ধু নজরুলকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। ভারত থেকে তাকে এই দেশে আনিয়ে এদেশের নাগরিকত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আসলে নজরুলকে চিনতে পেরেছিলেন।
প্রধান অতিথি বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি হয়েছে, মানবসম্পদে উন্নত হচ্ছে- কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সংস্কৃতি চর্চাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই মানুষের মাঝে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জেগে উঠবে।
এদিকে, বিকেল ৪টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় কবিতানুষ্ঠান। এসময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কবি আমিরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল হামিদ ও কালিগঞ্জ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান। কবিতানুষ্ঠান শেষে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
প্রথম দিনের সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। জেলার স্থানীয় শিল্পী ও দেশের বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞরা নজরুল সঙ্গীত ও নৃত্য প্রদর্শন করেন। এছাড়া তালা, কালিগঞ্জ ও সদর উপজেলার শিল্পীরা তাদের সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। এসময় অতিথি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. লীনা তাপসী খান।
উল্লেখ্য ‘নজরুলের অপ্রচলিত গানের সুর সংগ্রহ, স্বরলিপি প্রণয়ন, সংরক্ষণ, প্রচার এবং নবীন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরায় তিন দিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২য় দিনের অনুষ্ঠান মালা: ২০ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কবি ও প্রাবন্ধিক সৈকত হাবিব। এছাড়া আলোচনা করবেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওলিউর রহমান। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঞার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক বিশ্বাস সুদেব কুমার।
বিকেল ৪টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থানীয় কবিদের অংশগ্রহণে কবিতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাতক্ষীরা-১ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঞার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কবি গোলাম কিবরিয়ার পিনু ও দিবা নৈশ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শুভ্র আহমেদ।
জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। এসময় কলারোয়া, দেবহাটা ও সদর উপজেলার শিল্পীদের অংশগ্রহণে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এতে অতিথি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ইয়াকুব আলী খান, শহীদ কবির পলাশ এবং বদরুন্নেসা ডালিয়া।
নজরুল সম্মেলনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন : ধর্ম-বর্ণ নিয়ে বিভেদ নয়, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/