বাহলুল করিম: আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সাতক্ষীরার তিনশ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলা। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ এই উৎসব চলবে মাসব্যাপী। মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তরফদার মাহবুবুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. তাওহীদুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মেরিনা আক্তার ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তহমিনা খাতুন।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আনিছুর রহিম, প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ হোসেন, পৌরসভার সচিব সাইফুল ইসলাম বিশ্বাস, পৌর কাউন্সিলর শফিক-উদ্দৌলা সাগর, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মনোরঞ্জন মুখার্জী, জেলা মন্দির কমিটির সভাপতি বিশ^নাথ ঘোষ পুরাতন সাতক্ষীরার ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সেলিম, শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সচিব মুশফিকুর রহমান মিল্টন, রঘুজিত গুহো, জাহাঙ্গীর হোসেন কালু, গোষ্ঠ বিহারী প্রমুখ।
সভায় জানানো হয়, বিশ^কর্মা ও মনসা পূজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিতব্য এই মেলা সাতক্ষীরার তিনশ বছরের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ বছরও জাকজমকপূর্ণ পরিবেশে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার উদ্যোগে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় জুয়া, হাউজি, লটারি, র্যাফেল ড্র, লাকিকূপন, ফড়, চরকি, নগ্ন নৃত্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। পৌরসভা সাময়িকভাবে মেলা প্রাঙ্গণে ২০টি গণ শৌচাগার নির্মাণ করবে। খুলনা রোড মোড় হতে ইটাগাছা বাজার পর্যন্ত ও লাবণী মোড় হতে রাজ্জাক পার্ক পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত না করে মেলার স্টল স্থাপন করা যেতে পারে। লৌহজাত দ্রব্য, বাঁশ ও বেতের দোকান পলাশপোল স্কুলের পাশে বসবে। পলাশপোল স্কুল হতে খুলনা রোড পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে নার্সারির দোকান বসবে। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে মনোহারির দোকান বসবে। শিল্পকলা একাডেমির সামনে নাগরদোলা ও রেলগাড়ি বসবে। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির দোকান বসবে। রাজ্জাক পার্কে অবস্থিত প্রত্যেক ব্যবসায়ীর নিকট থেকে মেলা পরিচালনার খরচ বাবদ ট্যাক্স হিসেবে সাতক্ষীরা পৌরসভা পাকা রশিদের মাধ্যমে ২০০ টাকা উঠাতে পারবে। পার্কের বাইরে অন্যান্য স্থানে যারা দোকান দেবেন তাদের ৩০ দিনের ব্যবসা পরিচালনার অথরিটি হিসেবে পৌরসভা কর্তৃক একটি প্রত্যয়ন পত্র দেবে ও খরচ বাবদ প্রতি দোকানের নিকট থেকে ২০ টাকা গ্রহণ করা হবে। গুড়পুকুরের পাশে পূজামÐপের স্থানে গেটসহ স্টেজ ও পাকাপোলের মোড়ে মেলার অনুষ্ঠান বিষয়ে প্রচারের জন্য একটি গেট নির্মাণ করা হবে। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে মেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে। মেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য মেডিকেল টিম গঠন করা হবে।
সভায় আরও জানানো হয়, মেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ ফোর্সসহ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। রাস্তায় যানজট নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হবে। একই সাথে পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও ভিডিপি সদস্য, স্কাউট, রোভার স্কাউট ও স্থানীয় যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হবে।
মেলা চলাকালীন সিনেমা হলগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হবে। মেলায় অবৈধ কার্যক্রম রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলা ১লা আশ্বিন ৩০ দিনব্যাপী গুড়পুকুর মেলার উদ্বোধন হবে। গত বছরের মতো মেলার লোকেশন একই থাকবে। মেলা প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। মেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মেলায় পৌরসভার পক্ষ থেকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পূজা মÐপের পাশে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। পৌরসভা কর্তৃক মেলার প্রতিটি স্টল থেকে যে টাকা ফি হিসেবে ধার্য করা হয়েছে- তার যথাযথ হিসাব রাখতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা গত বছরে একটি সুন্দর মেলা উপহার দিতে পেরেছিলাম। আশাকরি এবারও সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, মূল পূজার জায়গাটা খুব নোংরা থাকে। এই জায়গাটা আপনাদের পক্ষ থেকে পূজার উপযোগী করে তৈরি করবেন। গতবার গুড়পুকুরের মেলাটা ভাল জমেছিল। রাত ৯টার পরে মেলার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। কেননা মেলায় অনেক মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। সকলের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমাদের টিম সব জায়গায় নজরদারিতে থাকবে। মেলায় যাবতীয় আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের। মেলায় আগত সকলকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা সবকিছু করবো। গতবার মেলায় কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আশাকরি এবারও সকলের প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর মেলা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার তিনশ বছরের ঐতিহ্য গুড় পুকুরের মেলা নিয়ে নানা রকম জনশ্রুতি আছে। কেউ বলে, মোগল আমলে একজন রাজকর্মচারী আজকের সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের মনসাতলায় (বটবৃক্ষতলে) বিশ্রাম নিতে গিয়ে তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র। হঠাৎ তিনি জেগে দেখেন, একেবারে কাছেই একটি সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দিচ্ছে যাতে ঘুমাতে পারেন। সেই থেকে তিনি ওই বটতলায় সাপের দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা শুরু করেন এবং অন্যদেরও মনসা পূজা করতে বলেন। এ পূজার প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেয়ায় এর পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এ কারণে ওই পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড়পুকুর।
অন্যরা বলেন, পুকুরে বেশি দিন পানি থাকত না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা সেখানে ১০০ ভাড় গুড় ঢেলে দিলে পুকুরে পানি ওঠে, তাই এমন নামকরণ। আবার শোনা যায়, আশপাশের খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরির পর তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থেই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল।
আরেকটি মত হচ্ছে, গৌর বর্ণের ব্রাহ্মণরা পুকুরটির মালিক ছিলেন। এ থেকেই গৌরদের পুকুর। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় গুড়পুকুর।
নামের শানে-নজুল যা-ই হোক, পুকুরের নামেই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে হয়ে আসছে মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজাও। এলাকার অনেকেই বলেন, ওই দুই পূজা ঘিরেই মূলত গুড়পুকুর মেলা। যা সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ উৎসব।
তবে, ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুড় পুকুরের মেলার সার্কাস প্যান্ডেল ও সাতক্ষীরার রকসি সিনেমা হলে জঙ্গি হামলায় তিনজন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। সেই থেকে ঐতিহ্য হারাতে বসে এ মেলা। এরপর থেকে মেলার আয়োজন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ উৎসব: ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলা শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/