বিতর্ক মূলত কথার নান্দনিক উপস্থাপন। আর সেই কথা বলতে পারা- এটা মানুষের এক বিরাট ক্ষমতা। কিন্তু ক্ষমতা যদি যথাযথ ব্যবহার না করা হয় তবে সেই ক্ষমতার কি মূল্য থাকে? মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে শুধু এই কথার মাধ্যমে। প্রাচীনকালে কারও সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কারও কাছে কোন দরকার ছিল না। কোথাও কোন নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন তো ছিলই না। যে কারণে কথা বলাটা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একসময় সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সমাজে ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে তার চলাফেরা করার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। কারণে-অকারণে সে নিত্যদিন কথা বলছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাদ-প্রতিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার যে ক্ষমতা তার কি যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে? বিতর্ক মানুষকে সেই ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করতে শিখিয়েছে। বিতর্ক হলো সৃজনশীলতার মাধ্যমে কথার উপস্থাপন। বিতর্কে থাকে যে কোন বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ। থাকে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আর যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণে সৃজনশীল এই শিল্পকে ‘বিতর্কশাস্ত্র’ বলা হয়।
বিতর্কের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়, প্রাচীন শিল্পের মধ্যে বিতর্ক অন্যতম এবং বর্তমানে বিশ্বের অভিজাত, সৃজনশীল এবং যৌক্তিক শিল্পসমূহের মধ্যে বিতর্ক একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৯ সালে প্রাচীন গ্রিসের সোফিস্ট সম্প্রদায়ের মাধ্যমে এই বিতর্কের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসের মাধ্যমে বিতর্ক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। বর্তমানে বিতর্ক সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং পরিশীলিত ভাষা চর্চার মাধ্যম। যে কারণে দিনের পর দিন বিতর্ক বেশ সম্ভাবনাময় বাকশিল্প হয়ে উঠছে।
বিতর্ক কিন্তু তর্ক নয়। বিতর্কে নান্দনিক কথামালা উপস্থাপনার মাধ্যমে অপরমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা হয়। আর যিনি এই যৌক্তিক গঠনমূলক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথামালা দিয়ে কথা বলেন তিনিই বিতার্কিক। প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি বলেছেন, “বিতর্ক যেন একটি অভিযান, তার পদে পদে নব নব আবিষ্কার, নতুনতর অভিজ্ঞান।” বিতর্ক নিয়ে আরেক প্রাবন্ধিক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, “যারা প্রশ্ন করতে শেখে না তারা আধুনিক মানুষ নয়, বিতার্কিকরা প্রশ্ন করতে শেখে তাই তারা আধুনিক মানুষ।”
সুতরাং বিতর্ক হলো যুক্তি, তত্ত্ব আর তথ্যের সমন্বয়। যেখানে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা ও ভিন্নমতকে গঠনমূলক পন্থায় সমালোচনা করা হয়। একই সাথে বিতর্ক হলো সাবলীল, স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল কথার মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণী অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের শিক্ষাই হলো বিতর্ক। বিতর্ক মানে কারও মতের বিরোধিতা করা নয় বরং যৌক্তিক ভাষা এবং সর্বজন গ্রহণীয় শব্দমালার সৃজনশীল উপস্থাপনা।
বিশ্বের বড় বড় বক্তারা নিজেদের কথার ঝংকার দিয়ে কেউ দেশে চালিয়েছেন, কেউ একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন আবার কেউবা বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সমস্ত মানুষের সঠিক পথে চলার তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে। হযরত মোহাম্মদ (স), নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন, শেখ মুজিবুর রহমান, এপিজে আবুল কালাম, মাহথির মোহাম্মদসহ হাজার হাজার মানুষ আছেন যারা নিজেদের কর্মের চেয়ে গঠনমূলক কথামালার মাধ্যমে পরিবর্তনের নূতন যুগের সূচনা করেছেন। সেই বিতর্ক আজ শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পুরো বিষয়টি নিয়ে আবার চিন্তা করা উচিত। বিতর্ক মানে কি? এটাই বুঝতে বোধ হয় কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছে। আজকের বিতর্ক মানে শুধু প্রতিযোগিতা আর পুরস্কার। পত্র-পত্রিকায় ছবি আর দল বেঁধে উল্লাস। কিন্তু বিতর্ক তো কোন আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। এখানে প্রতিযোগিতাটা কোন গুরুত্বের বিষয় নয়। বরং আমার বিতর্কের মাধ্যমে কতটুকু ভাষার প্রাঞ্জলতা, শুদ্ধতা এবং যৌক্তিক বোধের প্রকাশ হচ্ছে সেটা দেখাই প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ।
একটাবার ভাবুন তো, শেখ মুজিবুর রহমান আর মাহথির মোহাম্মদ যদি এক মঞ্চে এসে বক্তেব্যের প্রতিযোগিতা করেন তবে সেটা মানুষ কতটুকু গ্রহণ করবে? না কি নান্দনিক উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে জনগণের প্রতি আহবান সমৃদ্ধ কথামালার ঝংকারগুলো মানুষ বেশি আগ্রহ ভরে শুনবে? আসলে আজকের বিতর্ক শুধু ক্রেস্ট আর মেডেল নেওয়া বিতার্কিক তৈরি করছে কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তা খুবই কম ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। চলমান ঘটনা নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে, মানুষের প্রয়োজন নিয়ে, আমাদের দেশে আজ বিতর্ক হচ্ছে না। বরং সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে নিয়ম রক্ষার বিতর্ক প্রতিযোগিতা।
সারাদেশে বিতর্ক নিয়ে হৈ হুল্লোড় পড়লেও আমাদের এই জেলা শহর সাতক্ষীরাতে তেমন খুব একটা প্রভাব পড়ে না। মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও হয় না কোন কর্মশালা। আবার কিছু বিতার্কিক তৈরি হলেও তাদের নিয়মিত পরিচর্যা করার মত নেই কোন ব্যক্তি বা সংগঠন। কেউ কেউ এক হতে চাইলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় সে সুযোগ হয়ে ওঠে না।
বিতর্ক শিল্পের অগ্রগতির পিছনে কিছু বাঁধা অবশ্য কাজ করে যেগুলো না থাকলে হয়তো আরও বেশ স্বাচ্ছন্দে এগিয়ে যেত বিতর্কের কার্যক্রম। একজন বিতার্কিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে ঝামেলাটি আমাদের ভোগায় তা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বেশি প্রয়োজন। দেশের বেশিরভাগ জেলায় বিভিন্ন বিতর্ক সংগঠনের কার্যক্রম থাকলেও আমাদের এই জেলায় স্থায়ী কোন সংগঠন গড়ে ওঠেনি। রাজধানী কেন্দ্রিক যেহেতু আমাদের পথচলা তাই ঢাকার সাথে দূরত্ব আমাদের আরও পিছিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পদ্মা সেতু হলে আশা করা যায় সেই প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না। দেশ সেরা বিতার্কিকদের সংস্পর্শ পেলে এই জেলার শিক্ষার্থীরা হয়তো আরও বেশি পারদর্শী হয়ে উঠবে। নিয়মিত কর্মশালা আর চর্চার মাধ্যম পেলে আরও বেশি শাণিত হবে বিতর্কের কার্যক্রম। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যেদিনের স্বপ্ন আমরা দেখি। যখন বিভিন্ন কর্মশালায় যাই, তখন খুব বেশি মনে হয় নিজের জেলাকে এই ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে পারলে বোধহয় কিছুটা সচেতন আর আধুনিক মানুষ তৈরি হতো। কারণ প্রাবন্ধিক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিতার্কিকদের আধুনিক মানুষ বলেছেন।
তবে, সব মিলিয়ে যে আমাদের ভৌগলিক সমস্যা তা-ই শুধু নয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়ার আগ্রহ কমে গিয়েছে। তারা এখন আর পড়ে বিতর্ক করতে চায় না। বিতর্কের দিন আসলে নির্দিষ্ট বিষয়ে কিছু গৎবাঁধা লেখা দেখেই কথা বলে থাকে। তবুও তারা যদি সর্বত্র প্রেষণা পেতে থাকে তবে বিতর্ক ক্ষেত্রে আরও ভালো কিছু ফল আনা সম্ভব বলে বিশ্বাস রাখি।
আগেও বলেছি, বিতর্ককে তর্কের পর্যায়ে নামিয়ে নিলে আসলে তখন আর সৌন্দর্য টিকে থাকে না। আমরা বিতর্ক করবো, তর্ক নয়। তর্কে থাকে না যুক্তি। আর বিতর্কে থাকে আবেগ। আসল কথা হচ্ছে, বিতর্ক অলংকার আর আবেগের সংমিশ্রণ। পৃথিবীতে এমন কোন ভালো বিতর্ক নেই যেখানে আবেগ আর যুক্তি একসাথে মিশ্রণ হয়নি। বিতর্কে আবেগ-ই হলো অলংকার। যে কারণে অলংকার বাদ দিলে মনোমুগ্ধকর বিতর্ক হওয়া খুবই কঠিন।
বলে রাখা ভালো, অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন কেন বিতর্ক করবো? জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক তার লেখনীতে বলেছেন, মানুষের চিন্তার পেছনেও চিন্তা আছে। জ্ঞানের বিপরীতেও জ্ঞান আছে। যুক্তির বিপরীতেও যুক্তি আছে। আর এই বিষয়গুলোই বিতর্ক করতে শেখায়। আর এসব কারণে বিতর্ক পুরোটা সময়েই জনপ্রিয় অবস্থান ধরে থাকবে। এছাড়াও, বিতর্ক একজন মানুষের এমন সব গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করে যা অন্য কোন কাজ দ্বারা সম্ভব নয়। যেগুলোর মধ্যে, গুছিয়ে কথা বলার দক্ষতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। বর্তমান সময়ে অপরমতের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব দেখা যায় সেখানেও বিতর্ক অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানা এবং সম্মান করার ব্যাপারে শিক্ষা দিয়ে থাকে। নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা, জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো, বিপক্ষের যুক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়গুলোও বিতর্ককে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে।
সবশেষে দুটো কথা বলে শেষ করতে চাই। অনেকে বলে থাকে বিতর্ক শিখবো, বিতর্ক করবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। আসলে বিতর্ক হতে হবে তোমার নিজের ইচ্ছেই। বিতর্ককে মনে করতে হবে কথা বলার কৌশল। যেখানে সৃজনশীলতা থাকবে। এটা মেনে নিয়েই তোমাকে বিতর্কে কাজ শুরু করতে হবে। আর একটা বিষয় আবারও বলা, তা হলো বিতর্ক যেন ব্যবসায়ী পণ্য না হয়ে যায়। তাহলে বিতর্ক শুধুই আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে পড়ে যাবে। আবেদন কমে যাবে সাধারণ মানুষের কাছে।
তাই আমার আবেদন সবার কাছে, যদি প্রতিযোগিতা হয়, হোক, তবে তার চেয়ে বেশি হোক পুরস্কারহীন প্রতিযোগিতা। এক সপ্তাহ বিতর্ক হলে, দুই সপ্তাহ কর্মশালা আর প্রশিক্ষণ হোক। যেখানে চলবে যৌক্তিক, গঠনমূলক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথামালার শুদ্ধ উচ্চারণের প্রশিক্ষণ। বিচারক আর বিচারের কাগজ নিয়ে নয়, বিতর্ক হোক আনন্দের। বিতর্ক হোক সৃজনশীলতার। বিতর্ক হোক জ্ঞান চর্চার মাধ্যম। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর চর্চা।
..
লেখক: সাব-এডিটর, দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা ও বিতার্কিক, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ