ইন্দুলেখা সাম্যের গান গায়। সে হবে প্রীতিলতা, ইলা মিত্র কিংবা মালালার মতো গোলাপ। ইন্দুলেখার কাছে নেই কোনো জাতপাতের বিচার। আগুনের ফুলকি হয়ে সে হবে এক ইতিহাস।
সাম্যের পূজা করতে গিয়ে এভাবেই ‘ইন্দুলেখা আগুনের ফুলকি হবে’ তুলে ধরেছেন কবি। বলেছেন সেই ইন্দুলেখা মুক্তিযোদ্ধার নামাংকিত সড়কের পাশেই বড় হয়ে উঠছে।
কবি মৃন্ময় মণ্ডল নিজের কাব্য মানসের আঁচলে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ এভাবেই তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কিছু মাংসলোভী শিয়াল কুকুর ছাড়া সবাই হাতে হাত রেখেছিল। তিনি চিহ্নিত করেছেন স্বদেশের ঠিকানা ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের তো তার নাইকো শেষ’।
মৃন্ময় মণ্ডলের কাব্যিক বচনে উঠে এসেছে পহেলা মের শ্রমিকদের দৃপ্ত শপথের ইতিহাস। তাদের শ্রমের ফসল তবু এখনও বিকৃত উল্লাসে কেড়ে নেয় দুর্বৃত্ত। শ্রমিকদের প্রতিবাদী জীবন নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘প্রতিবাদী জীবন, জীবনের জন্য, প্রতিবাদী মানুষ, মানুষের জন্য’। শিশুকে তিনি শ্রমজীবী জনকের উত্তরাধিকার আখ্যায়িত করে শ্রমিক সমাজের ঘামে ভেজা ফসল রক্ষায় প্রতিবাদের ঝাণ্ডা আরও শক্ত মুঠিতে ধরবার সাহস যুগিয়েছেন। কবি মৃন্ময় মণ্ডল যাপিত জীবন ও গ্রামের বর্ণনায় বলেছেন ‘নবান্নের প্রতীক্ষায়, মহাজনের গোলা ভরে যদি থাকে কিছু, তুলে নেবে শীর্ণ হাতে হিরন্ময় দানা’। মহান একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণে তিনি বলেছেন, ‘নিরন্তর ভালবাসার টকটকে তাজা গোলাপ, ছড়িয়ে দেব সব শহীদবেদিতে শ্রদ্ধাবনত। ওই দেখ রফিক শফিক সালাম বরকত জব্বারের সমাধিতে লক্ষ জনতার ঢল’। ঘামঝরা পরিশ্রম করে ছায়া শীতল গ্রামের বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে আহলাদ করে পার্কের জনসভার ভাষণের বর্ণনা দিয়ে স্বামীর উক্তি ‘দেহিস বানু, ইবার মোগের কষ্ট যাবে। জমি পামু, গরু পামু, ফসল পামু, খাতি পামু পেটপুরে’। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের এই প্রত্যাশায় কবি ঘৃত ঢেলে তাকে আরও জাগরিত করে তুলেছেন। প্রতিবাদের লাল টকটকে চোখে প্রশান্তির অশ্রু ফুটে ওঠে তার।
কবি মৃন্ময় মণ্ডল ভুল করেন নি লালন ফকিরের গানের ব্যঞ্জনা আর সুরের মুর্ছনা শোনাতে। ‘লোকের পাশে লোক, দাঁড়ানো দেশের পাশে দেশ, নাফের জলে ভাসবে না আর রক্তমাখা কেশ’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘উদার আকাশ আর অসামান্য সমুদ্রের অতল প্রেমে, ভেসে বেড়ান বিশ্বময়, কণ্ঠে বাজে ভালবাসার পদাবলী। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। আর বিদ্রোহী কবি নজরুলকে তিনি বলেছেন‘ ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দোলানো নজরুল, বিদ্রোহী নজরুল, দুরন্ত নজরুল, আমার অস্থি মজ্জায় মিশে আছে বিরহী বকুল, আছে শিকল ভাঙ্গার গানের পাখি দুর্দান্ত নজরুল’। কবি মৃন্ময় ম-ল তার কাব্যিক ছন্দে স্মরণে এনেছেন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটার রুবি রায়, হাচন রাজার ‘জাত গেল জাত গেল বলে’ গানের কলি। এনেছেন জীবনানন্দ দাসের ‘নাটোরের বনলতা সেন’কেও। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্ত স্বদেশ এর লাল সবুজের ছায়াতলে বাঙালিকে সুখে থাকার আশীর্বাদ করেছেন তিনি। কষ্টের ঘামকে তিনি ঝরো ঝরো নির্ঝর বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। সমাজের ধনীকদের আরাম আয়েশের দিকে ইঙ্গিত করে কবি বলেছেন, ‘সুখ বুঝি তোমাদের আজন্মের দাস’। তাদের ভণ্ড মুখোশ ছিড়ে পড়ার প্রত্যাশা করেছেন কবি। তিনি লিখেছেন, দূর হোক আঁধার, দূর হোক বিভেদ, দূর হোক দুঃসহ জীবন। এভাবেই তিনি খেতে চেয়েছেন জীবনকে।
ইলেকট্রনিক মানুষের কথা বলতে গিয়ে কবি খান পাঁচেক সার্টিফিকেটধারীকে শূন্যবিদ্যা অহংকারী হিসাবে সমালোচনা করেছেন। ‘ডিম পাড়ে মুরগি খেয়ে যায় দারোগা’ এমন দুঃসময়ের কথা বলতেও ভোলেন নি তিনি। সমাজের সব অনিয়ম বিশৃংখলা অন্ধকার পথ আর বাধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে কবি সবাইকে সাম্যের অবিরাম অমিয় ঝর্ণাধারায় নিয়ে আসতে চান। আর তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা বাধা ভাঙবোই, দুঃসময়ের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে মানুষের রাজ গড়বোই’।
শব্দ চয়নে নিজস্ব ভঙ্গিতে কবি মৃন্ময় মণ্ডল যা লিখেছেন তাকে বলা যায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত। একে বলা যায় চারিদিকে বিদ্রোহের ডাক। বলা যায় আলোকিত সমাজ গড়ার এক অবিরাম সংগ্রাম। ইন্দুলেখা তাই আগুনের ফুলকি হয়ে চমকে দিতে চায়। গড়তে চায় এক নতুন ইতিহাস।
৩৬টি কবিতার একগুচ্ছ স্বরলিপির ‘ইন্দুলেখা আগুনের ফুলকি হবে’ এর লেখকের কাব্য প্রেম শুরু শিশুকাল থেকে। এখন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলের কাছাকাছি এসে কাব্য মানসের নতুন বিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে জেগেছে বিদ্রোহের মিছিল, তার অন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে প্রতিবাদী আন্দোলনের অবিরাম স্রোত।
নিঃসন্দেহে মৃন্ময় মণ্ডলের কবিতাগুলো সুখপাঠ্য। শব্দচয়ন, কথার গাঁথুনি, ভাষার মাধুর্য, আধুনিকতার ছন্দ, ফেলে আসা অতীতের দিনগুলোর সাথে বর্তমানের তুলনা একজন কাব্যপ্রেমীর হৃদয়ে এনে দিতে পারে ভরা জোয়ার। মেটাতে পারে কাব্য তৃষ্ণা।
কবি মৃন্ময় মণ্ডলের অসামান্য সৃষ্টি ‘ইন্দুলেখা আগুনের ফুলকি হবে’
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/