Site icon suprovatsatkhira.com

‘এসিড সন্ত্রাসীদের সাথে আপোষ নয়’

বাহলুল করিম: সাতক্ষীরায় সেতু বন্ধন গড়ি নেটওয়ার্ক (নেটওয়ার্ক অব এসিড সারভাইভরস) এর বার্ষিক সাধারণ সভায় এসিড সন্ত্রাসীদের সাথে আপোষ না করার আহবান জানানো হয়েছে।
বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এসবিজিএন’র আয়োজনে এবং একশন এইড ও স্বদেশের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত সভায় এই আহবান জানানো হয়।
সভায় এসিড নির্যাতনের শিকার সদর উপজেলার ভোমরার ছফুরা খাতুন বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা ব্যক্ত করে বলেন, জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষ আমার মুখে এসিড ছুড়ে মারে। যখন আমি এসিড দগ্ধ হই তখন কেউ আমাকে পছন্দ করতো না। তখন আমি খুব অসহায় হয়ে পড়ি। ঢাকা থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলে এসিড সন্ত্রাসীরা আমাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিতো। এরপর আমি স্বদেশের সহযোগিতায় ভোমরা থেকে সাতক্ষীরা, সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে লন্ডন পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। এখন সবাই আমাকে খুব ভালবাসে, খুব আদর করে। এখন আমি নিজে সাবলম্বী।
এসিডে দগ্ধ সাতক্ষীরা সদরের ভবানীপুরের হাছিনা খাতুন তার সাফল্যগাঁথা তুলে ধরে বলেন, ২০০৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমি এসিডে আক্রান্ত হই। এরপর আর্থসামাজিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি। পরে সেতু বন্ধন নেটওয়ার্কের সদস্য হই। এরপরে আমি স্বদেশ ও একশন এইডের সহযোগিতায় সবজি চাষের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি স্বদেশ ও একশন এইডের যৌথ সহযোগিতায় ১০ হাজার টাকার আত্মকর্মসংস্থানমূলক সহায়তা পাই। বর্তমানে সবজি চাষ ও পশু পালনের মাধ্যমে সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছি। ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে সবজি চাষ ও পশুর খামার করার পরিকল্পনা নিচ্ছি।
কালিগঞ্জের এসিডে আক্রান্ত ওয়াহেদ তার দুর্দশার কথা ব্যক্ত করে বলেন, জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষ আমাকে এসিড মারে এবং আমার হাত ও পা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। তখন এলাকার মানুষ আমাকে কোন প্রকার সহযোগিতা করেনি। তখন স্বদেশ টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসার খরচ চালিয়েছে। ঢাকা থেকে চিকিৎসা নিয়ে যখন আমি বাড়ি ফিরি তখন প্রতিপক্ষ নানাভাবে আমাকে হুমকি দিতে থাকে। বলে তোকে বাড়ি থাকতে দেব না। তোকে গাছে ঝুলিয়ে রাখবো। পরে স্বদেশের দেওয়া ১০ হাজার টাকা দিয়ে কালিগঞ্জে একটি দোকান দেই। দোকান দেওয়ার চার বছর পরে আশেপাশের লোকজন আমাকে দোকান থেকে তাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালায়। এসব বিষয় স্বদেশে জানালে কালিগঞ্জের সার্কেল অফিসারকে জানানোর পরামর্শ দেয়। পরবর্তীতে আমার দোকান ভেঙে কালিমন্দিরের ভিতরে রেখে দিয়েছে। এ ঘটনায় ১১ জনের নামে মামলা করি। পরে ভেরিফিকেশনের জন্য এই মামলাটা সমাজসেবা অফিসের আওতায় দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজসেবা এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এখনো পর্যন্ত আদালতে মামলা চলছে। সমাজসেবায় তথ্য নিতে গেলে তারা দিতে চায় না। তারা বলে এ ব্যাপারে তথ্য দিলে আমাদের চাকরি থাকবে না। থানায় গেলে তারা বলে আমরা এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বরের সাথে গ-গোল করতে পারবো না। এখনো এসিড সন্ত্রাসীরা আমাকে হুমকি দিচ্ছে।
পাটকেলঘাটার নোয়াকাঠি গ্রামের ছোট্ট শিশু সোনালী খাতুনের বাবা বলেন, ২০০৩ সালের ২৮ নভেম্বর জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে আমি, আমার স্ত্রী ও ১৮ মাসের ছোট্ট মেয়ে এসিডে দগ্ধ হই। এরপরে আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হই। সামাজিকভাবে সকলের কাছে অবহেলিত হতে থাকি। তখন এসিড সারভাইভরদের সহযোগিতায় ও নিজের টাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। এ ব্যাপারে থানায় মামলা করলে আদালত মামলা খারিজ করে দেয়। তিনটি মানুষ সবার একই অবস্থা। কে কাকে দেখবে। অনেক কষ্টে দিন কেটেছে। এসিডে স্ত্রীর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে সারাক্ষণ পানি পড়ে। মেয়ের মুখটা সম্পূর্ণভাবে ঝলসে গেছে। এখনো পর্যন্ত মেয়ের চিকিৎসা চালাতে হচ্ছে। এসিড লেগে স্ত্রীর কানেরও সমস্যা হয়েছে। প্রথমে মেয়েকে যখন স্কুলে ভর্তি করি তখন তার চেহারা দেখে সকলে ভয় পেত। এখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
এসিডে দগ্ধ নূরুননাহার বলেন, আমি নিজে এসিডে আক্রান্ত মানুষ। আগে আমাকে কেউ দেখতে পারতো না। আমি একটি চাকরি করতাম। এসিডে দগ্ধ হওয়ার পরে আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তখন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন অতিবাহিত করেছি। এখন আমি বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসারের খরচ চালায়। চেহারা দেখে কেউ আমাকে কাজ দিতে চায় না। সবাই ঘৃণা করে। আমার আবেদন আমাকে একটি কাজ দেওয়া হোক।
সভায় এসিড সারভাইভরস সোসাইটির আহবায়ক ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজহার হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা খাতুন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর আব্দুল হামিদ, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তারাময়ী মুখার্জী, সমাজসেবা কর্মকর্তা শেখ শহিদুর রহমান, একশন এইডের সিনিয়র প্রোগাম অফিসার নূরুননাহার ও জনকণ্ঠের রিপোর্টার মিজানুর রহমান।
সভায় শেখ আজহার হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় ১৬৫-১৬৭ জন নারী ও পুরুষ এসিডে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক পন্থা রয়েছে। তাই বলে মুখে এসিড মারতে হবে? যারা এসিড সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তাদের সাথে আপোষ নয়। সাতক্ষীরা জেলা এসিড আক্রান্তে বাংলাদেশের শীর্ষে। তবে, ২০১৮ সালে একটিও এসিড আক্রান্তের ঘটনা ঘটে নি। এটা আমাদের অনেক বড় একটা অর্জন। এটা সম্ভব হয়েছে আপনাদের সংঘবদ্ধ থাকার কারণে। আগে আপনারা ঘরের ভিতর নিজেদের লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু এই সংগঠন আপনাদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। আপনাদের লন্ডন পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। আপনার সকলেই নিজেদের চেষ্টায় সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করুন। সংগঠন সব সময় আপনাদের পাশে আছে। আপনাদের পুনর্বাসনে সংগঠন সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজ সকলের জন্য, কারও একার জন্য নয়।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের জেলা প্রতিনিধি রেজাউল সানা, রেড সংস্থার পরিচালক লুইসরানা গাইন, জিডিএফ এর সভানেত্রী ফরিদা আক্তার, সেতু বন্ধন নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি ছফুরা খাতুন, সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল, নাজমুল আলম মুন্না, ওয়াহেদ, সোনালী খাতুন, ছফুরা খাতুন, হাচিনা, জবেদা খাতুন প্রমুখ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version