মোশাররফ হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি: একটি পৌরসভাসহ ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলার নাম কলারোয়া। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে এলাকাটি রাজনৈতিক সহিংসতা প্রবণ হিসাবেও পরিচিত।
ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে গত নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসার পর দলের হাই কমান্ড যখন সারা দেশে নিজেদের ত্রুটি সংশোধন করে তৃণমূল থেকে দল গুছিয়ে আনার কাজ শুরু করে ঠিক তখনই কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। দলের দুই শীর্ষ নেতা ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন ও আমিনুল ইসলাম লাল্টুর দ্বন্দ্বই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। আর নিজেদের দ্বন্দ্বে মুখ দেখাদেখি বন্ধ রয়েছে এই দুই নেতার। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে। দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে তারাও। যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও।
ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। অন্যদিকে আমিনুল ইসলাম লাল্টু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দু’নেতাই ছাত্র রাজনীতি থেকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা নিয়ে উঠে এসেছেন।
তবে, এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে বর্তমানে বিরোধ উপজেলা থেকে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রাম পর্যন্ত ছাড়িয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নেতা-কর্মীরা। দুজনের কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ কারণে দুজনের কর্মী-সমর্থকরা প্রায়ই সংঘাত-সহিংসতায়ও জড়াচ্ছে। গত তিন বছরে দুই পক্ষে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, লুটপাট, মারামারিসহ দুই নেতার পক্ষের কর্মীরা অসংখ্য খবরের শিরোনামও হয়েছেন। মামলা-পাল্টা মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় হাজার ছুঁয়েছে। বর্তমানে এই দুই নেতাসহ তাদের পক্ষের দুই ইউপি চেয়ারম্যানও মামলার আসামি।
বিরোধ শুরুর কথা: ২০১৭ সালে ২৫ নভেম্বর পৌরসভা নির্বাচনে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা উপজেলা আ.লীগের সাবেক আহবায়ক সাজেদুর রহমান খান চৌধুরী (মজনু) কে প্রার্থী করার চিন্তা করে। তিনি রাজপথের ত্যাগী নেতা ও ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসাবে পরিচিত। দলের মহাসংকটেও তিনি জীবন বাজি রেখে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। সে সময় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করেন। অভিমানে থমকে যান মজনু চৌধুরী। ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে লড়াই করেন আমিনুল ইসলাম লাল্টু। প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ আর হতাশা থাকায় বিএনপি প্রার্থী গাজী আক্তারুলের কাছে হেরে যান তিনি।
আমিনুল ইসলাম লাল্টুর পক্ষের কর্মীদের অভিযোগ ছিলো ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন হিংসা করে দলীয় প্রার্থী লাল্টুকে পারাজিত করেছেন। নির্বাচনে হেরে আগুনে যেন ঘি ঢালেন লাল্টু। বিরোধ তীব্রতর হতে থাকে।
¯œায়ু যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষের কর্মীদের মধ্যে। একজন অন্যজনের ভালোটা দেখতেই পান না। এরই মধ্যে উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম সমস্যায় পড়লে প্রতিশোধ নিতে হামলে পড়ে তার বিরোধী পক্ষ। সে সময় কলারোয়া থানার ওসির সাথেও বিরোধে জড়িয়ে পড়ে আ.লীগের শীর্ষ নেতারা।
সময় গড়িয়েছে। ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন তার পক্ষের লোকদের যেমন ধরে রাখতে পারেননি তেমনি আমিনুল ইসলাম লাল্টুও তার পুরাতন মিত্রদের এক কাতারে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে দ্বিধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের চলমান আধিপত্যেও ফাটল ধরিয়েছে স্থানীয় স্কুল মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটি গঠন ও নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। সাজেদুর রহমান খান চৌধুরী ফিরোজ আহম্মেদের আস্থাভাজন হলেও এ কারণে তিনি তার থেকে অনেক দূরে। সুযোগে তাকে কাছে টানতে মরিয়া আমিনুল ইসলাম লাল্টুর লোকজন।
এদিকে, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আরাফাত হোসেন মাঠে নামেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনের পক্ষের লোক। তাকে কাউন্টার দিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টুর পক্ষের লোকজন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি কাজী আসাদুজ্জামান সাহাজাদাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করান। সাহাজাদা ফেল করলেও ৩০ হাজার ভোট পান। ওই নির্বাচনে দলের মধ্যে গ্রুপিং থাকায় ভোটাররা ক্ষোভে ২৬৪টি ব্যালটের উল্টোদিকে সিল মারেন। সে সময় নিজেদের কলহ মিটিয়ে একক প্রার্থী সেট করতে ব্যর্থ হওয়ায় ভোটাররা উল্টোপাশে সিল মেরে নীরব প্রতিবাদ করেছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
শীর্ষ এই দুই নেতার বৈরিতার কারণে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে সামাজিক কলহ বাধলেও সেখানে উপজেলার নেতাদের ইশারায় পৃথক পক্ষ নিয়ে জটিলতা বৃদ্ধি করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপন ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু।
২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্বীকৃতি উদযাপনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে দুই পক্ষের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠি চার্জও করে। এ ঘটনায় উপজেলার শীর্ষ দুই নেতার নাম উল্লেখসহ শতাধিক ব্যক্তির নামে মামলাও হয়।
পরে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাতক্ষীরায় এসে বিবদমান দুই নেতার হাতে হাত মিলিয়ে দেন। দলকে সংগঠিত করার কাজে বেশী বেশী মনোনিবেশ করার তাগিদ দেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাকতে শক্তিশালী করতে বলেন। পরামর্শ দেন জন সেবা ও স্বচ্ছতার সাথে দল পরিচালনা করতে। কিন্তু অবস্থা যাহা লাউ তাহাই কদু’র মতো।
গত ইউপি নির্বাচনেও একে অপরের প্রতিপক্ষ মনে করে প্রার্থী দেয়ায় সৃষ্ট ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি পরাজিতদের মন থেকে।
স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনেও দেওয়া হচ্ছে একই দলের দুই নেতার সমর্থক প্রার্থী। জাতীয় কর্মসূচি পালনও হয় আলাদাভাবে। গত ১৫ আগস্ট শোক দিবসও পৃথকভাবে পালন করেছে তারা।
উপজেলা সভাপতি-সম্পাদকের সূত্র ধরে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে উপজেলা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও শ্রমিক লীগও। তারাও এখন উপজেলা সভাপতি-সম্পাদকের মতো নিজেদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছেন।
বিব্রত প্রশাসন: কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছোট খাটো বিষয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় বিব্রত প্রশাসন। জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নিয়ে আমরা বিব্রত। জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা আটক হলেও কোন না কোন পক্ষ বলেন সে ভালো মানুষ বা আমার পক্ষের লোক। ছাড়তে হবে।
কলারোয়া আওয়ামী লীগের এই নাজুক অবস্থা নিয়ে এ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে সংবাদ কর্মীদের বলেছিলেন, গত পাঁচ বছরে কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ বিরোধে জড়িয়ে নিজেরা নিজেদের (আ.লীগের নেতা কর্মী) বিরুদ্ধে যত মামলা করেছে, তার সিকি ভাগও জামায়াত-বিএনপির কর্মী বা অন্যদের নামে হয়নি।
এ নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন হাইব্রিডদের সাথে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। দলের এই বিরোধ কে কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়াম্যান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দের অর্থ লোপাট করছেন। যে কারণে ত্যাগী ও তৃণমূল নেতারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেউ নয় তিনি এসেছেন ওয়ার্কার্সপার্টি থেকে। নৌকা প্রতীক পেয়েছিলেন বলেই তিনি এমপি হয়েছেন। এখানে তাদের (ওয়ার্কার্সপার্টির) ভোট আছে মাত্র তিনশটি। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা চাইছেন নৌকা প্রতীক অন্য দলের নেতাদের না দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হোক। তাহলে আমাদের মধ্যে কোন কোন্দল থাকবে না। কারণ মানুষ ভোট দেবে নৌকা প্রতীক দেখে ব্যক্তি নয়। তার পরও জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামী সংসদ নির্বচনে যাকেই মনোনয়ন দেবে আমি তারপক্ষেই কাজ করব।
কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন বলেন, ২০১৩ সালে সহিংসতার সময় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের পাশে থেকে জামায়াত বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম আমি। তারাই আমাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। আমার সাথে কারো বিরোধ নেই। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্যই আমার সম্পর্কে মিথ্যাচার করছেন। বিগত কলারোয়া পৌরসভা নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন কিন্তু পাশ করতে পারেননি। তার বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতারা তাকে পছন্দ করেন না। তিনিই দলের কিছু নেতাকে বিভ্রান্ত করে দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। তৃণমূলের নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচনে আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। তারপরও দল যাকে মনোনয়ন দেবে আমি তার পক্ষেই থাকব।
মুখ দেখাদেখি বন্ধ কলারোয়া উপজেলা আ.লীগের দুই শীর্ষ নেতার
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/