Site icon suprovatsatkhira.com

এমএ জলিলের রং তুলির আচড়ে ভেসে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি

বাহলুল করিম: ছোটবেলা থেকেই এমএ জলিল ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন।  ছবি আকাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান।  স্কুল জীবন থেকেই ছবি এঁকে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন।  সারাদিনের কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পান ছবি এঁকে সেই সময়টুকু ব্যয় করেন।  ছবিই যেন তার প্রাণ।  তার সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এক একটি ছবি যেন প্রাণ ফিরে পায়।  তার ছবিগুলো মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের কথা।  তার ছবিতে ফুটে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা।  এভাবেই তিনি হাজারেরও বেশি ছবি এঁকেছেন।  থেমে নেই এমএ জলিল, থেমে নেই তার আঁকাআঁকি।  কঠোর পরিশ্রম ও রং-তুলির প্রতি অগাধ ভালবাসাই আজ তাকে বসিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। হয়েছেন সাতক্ষীরার গুণী চিত্র শিল্পী।
গুণীজন এমএ জলিল ইহজাগতিক চেতনায় সমৃদ্ধ একজন সুমিষ্টভাষী মানুষ।  ১৯৫৯ সালের ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা জেলার পলাশপোল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।  বাবা মৃত জহর আলী পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা মৃত হামিদা খাতুন গৃহিনী।  পরিবারে ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।  স্ত্রী লতিফুন নাহার লতা এবং দুই পুত্র পাভেল রহমান ও শিহাব রহমানকে নিয়েই তার পরিবার।
চিত্রশিল্পী এমএ জলিল স্কুল জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হন ছবি আঁকার কাজে।  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রজীবনেই আঁকা-আঁকিতে হাতেখড়ি হয় তাঁর।  বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি।  চার ভাইয়ের মধ্যে তিনজনই ছিলেন ছবি আঁকায় পারদর্শী।
কোলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র প্রয়াত প্রফুল্ল কুমার ঘোষের হাত ধরেই চিত্রশিল্পে পদার্পণ করেন এমএ জলিল।  দীক্ষাগুরু প্রফুল্ল কুমার ঘোষের আঁকা ছবি দেখেই গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন তিনি।  তখন থেকেই ছবি আঁকায় আত্মনিবেশ করেন নিজেকে।
১৯৮২ সালে এমএ জলিল সাতক্ষীরা জেলার মিনি মার্কেট সংলগ্ন ঈষিকা আর্ট নামে একটি দোকান নেন। শুধুমাত্র রং ও তুলি নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন ছবি আঁকার কাজ।  প্রথমে সাইনবোর্ড ও অর্ডারের ছবি আঁকতেন।  বর্তমানে ছবি আঁকা, ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন, পাথরে খোদাইকৃত কাজও করেন।
প্রথম ছয় বছরে প্রায় দেড় শতাধিক ছবি এঁকেছেন রং-তুলির আঁচড়ে।  এর মধ্যে বিপ্লবী নেতা লেলিন, এঙ্গেলস, মাও সে তুং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানীর আঁকা ছবিগুলো অন্যতম।  নির্জীব ছবিগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায় তাঁর সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায়।  তা দৃশ্যমান হয়ে ধরা দেয় সকলের নজরে।
১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে এমএ জলিলের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে সাত দিনব্যাপী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।  এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে স্থান পায় ৫২টি ছবি।  উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে মাতৃত্ব, প্রতিকৃতি, ১৯৮৮ সালের ঝড়সহ বেশ কয়েকটি ছবি।  পাঁচশতাধিক লোকসমাগম হয়েছিল প্রদর্শনীটিতে।  অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন তিনি।
সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমীতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে (২৭-৩০) ঈষিকার অর্কেস্ট্রা নামে এমএ জলিলের দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।  প্রদর্শনীতে মোট স্থান পায় ১১০টি ছবি।  এর মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা মায়ের উদ্বিগ্নতা ছবিটি।  ছবিটিতে একটি চোখ দিয়েই বোঝানো হয়েছে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা একজন মায়ের উদ্বিগ্ন মনকে।  লাল, নীল, সবুজ, বেগুনী, আকাশি ও সাদা রঙে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতাকামী একজন মুক্তিযোদ্ধা মায়ের জলন্ত প্রতিচ্ছবি।  তাঁর মলিন মুখের অপলক চাহনি যেন প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে কবে আসবে স্বাধীনতা? প্রদর্শনী দেখতে আসা প্রত্যেকের হৃদয়স্পর্শী ছবি ছিল এটি।  এছাড়া ভাবনারত বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চের ভাষণ, গণহত্যা, খোঁজ, বলাকা আলাপন, বাদক, বিজয়, প্রকৃতি, শিরোনামহীন, গ্রাস, অনুশোচনা, ফেরা, উর্বশী, রাতের সুর, সোহাগ, কুস্তি, বৈশ্বিক উষ্ণতা, প্রতীক্ষা প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া উল্লেখযোগ্য ছবি।  প্রদর্শনী দেখতে ভিড় জমিয়েছিল সর্ব স্তরের মানুষ।  প্রদর্শনী শেষে ৭২টি ছবি সংরক্ষণের জন্য রাখা হয় সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমিতে।
২০১৯ সালে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমিতে আরও একটি চিত্র প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।  তৃতীয় প্রদর্শনীতে থাকবে প্রায় ১০০টির মতো ছবি।  ৩০টি ছবির কাজ শেষ।  এর মধ্যে আছে প্রতিবাদ, উত্তরাধুনিকতা, সতর্ক, বিজয়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের পূর্বাভাস ইত্যাদি। আরও ৭০টির মতো ছবির কাজ এখনো বাকি আছে।  খুব শীঘ্রই কাজ শেষ করবেন বাকি ছবিগুলোর।
চারুকলায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে এমএ জলিলকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ২০১৫ প্রদান করা হয়। জেলা শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে গুণীজন সম্মাননাও ২০১৫ প্রদান করা হয় তাকে।
একান্ত আলাপকালে এম এ জলিল বলেন, “প্রতিদিন রাতে ছবি আঁকার কাজ বেশি করা হয়।  শুক্রবারে টুকটাক কাজ করা হয়।  জল রঙে আঁকা ছবির সংখ্যা বেশি।  তবে তেল রঙের ছবির কাজ করতে বেশি ভালো লাগে।  জল রঙের ছবি আঁকতে এক-দুই দিন সময় লাগে।  আর তেল রঙের ছবি আঁকতে সময় লাগে তিন-চার দিন।”
তিনি আরও বলেন, “যত দিন কাজ করার সুযোগ থাকবে ততদিন ছবি আঁকার কাজ করবো।  এ পর্যন্ত আমার আঁকা ছবিগুলোর দুইটি একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।  ২০১৯ সালে আরও একটি চিত্র প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।  প্রায় ৩০টির মতো ছবির কাজ শেষ হয়েছে।  আরো ৭০টির মতো ছবি আঁকানোর কাজ বাকি আছে।  সংস্কৃতি মানুষকে ভালো পথ দেখায়।  সংস্কৃতিই জীবন, সংস্কৃতিই পারে সুন্দর মনের মানুষ তৈরি করতে।  হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সংস্কৃতিতে আত্মনিবেশ করার মাধ্যমে একজন ভালো মানুষ হওয়া সম্ভব।”

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version