Site icon suprovatsatkhira.com

শিশু বান্ধব সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখছে শিশু ফোরাম

আরিফুল ইসলাম রোহিত: শিশুবান্ধব সমাজ গঠনে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে গঠন করা হয়েছে শিশু ফোরাম। এসব ফোরামের সদস্যরা শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে কাজ করছে। একই সাথে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের শিশুরা অংশগ্রহণ করছে ইউনিয়নের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে। নিয়মিত মাসিক সভার মাধ্যমে শিশু ফোরামের সদস্যরা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছে জনপ্রতিনিধিদের কাছে।
সূত্র মতে, শিশু বান্ধব সমাজ বিনির্মাণে স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানুয়ালে শিশুদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে বেশ কিছু নিয়ম-কানুন জারি করা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে তদারকি না থাকায় সে সুযোগ তৈরি হয়নি। বিশেষত দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক শিশুদের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা থাকার পরেও সমাধানের সুযোগ মেলে না কোথাও।
সম্প্রতি ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ও সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতা ও পরামর্শে শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত¡াবধানেই গঠিত হয়েছে শিশু ফোরাম। এসব ফোরামে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা। তারা নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ৫০ জন করে শিশু সদস্য নিয়ে গঠিত এই ফোরাম স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে নিয়মিত মাসিক সভার মাধ্যমে শিশু কেন্দ্রিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স সূত্র জানায়, সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ২০১৪ সালের মার্চ মাস থেকে শিশু ফোরামের কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত ১৩৫টি দলে সর্বমোট ৬৭৫০জন শিশু যুক্ত হয়েছে। এসব দলে আরও কাজ করছে ওই সব এলাকার ৪০০ জন যুবক।
শিশু ফোরামের একটি ওয়ার্ডের সভাপতি ঊর্মি খাতুন জানায়, আমাদের এলাকায় কোন শিশুর সমস্যা পরিলক্ষিত হলে আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করে থাকি। এছাড়া আমরা প্রতি মাসে সভা করি। শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলি। যাতে তারা সচেতন হয় এবং নিজেদের কথা নিজেরাই বলতে পারে। একই সাথে জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি।
এছাড়া শিশু ফোরামের সদস্যরা স্থানীয় যুবকদের সম্পৃক্ত করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিশু অধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে । পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ইউনিয়নে স্থাপিত অভিযোগ বক্সে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়ে তা জনপ্রতিনিধিদের নিকট উত্থাপন করা হয়। শিশুবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জবাবদিহিতার বিষয়টি জনপ্রতিনিধিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। শিশুদের সরাসরি উত্থাপিত অভিযোগ এবং মতামতের প্রেক্ষিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ প্রত্যাশিত সেবা প্রদান সংক্রান্ত জবাবদিহিমূলক উত্তর ও কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করেন। আর এতে ইউনিয়নে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও প্রান্তিক শিশুরা সামাজিক সুরক্ষাসহ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেবা গ্রহণ করতে পারছে। মূলত ডায়ালগ সেশনের মাধ্যমে শিশুদের শিশু কেন্দ্রিক সমস্যা বা অভিযোগ উত্থাপনের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্র তৈরির সুযোগ দেয়া ও স্থানীয় সুশাসন নিশ্চিতকরণে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। যা বর্তমান সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেও বিবেচিত হচ্ছে।
এদিকে, শিশু ফোরাম গঠন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশের মাধ্যমে আগামী দিনের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে তারা। সর্বোপরি, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি ও শিশুবান্ধব স্থানীয় সুশাসন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। যা শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের এক বিরাট ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শিশুদের মতামত ও চাহিদার প্রেক্ষিতে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন হচ্ছে। যৌন হয়রানি ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মাটি ভরাট, টয়লেট সংস্কার, স্কুলের বেঞ্চ মেরামত, ফ্যান প্রদান, ইটের সোলিং মেরামত, ভাঙা পুল মেরামত, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশু স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে শিশু ফোরাম।
সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ফোরাম সদস্য আমিনুর রহমান জানায়, শিশুদের অধিকার সচেতন করে শিশু বান্ধব পরিবশে গড়ে তোলাই ফোরামের কাজ। নিয়মিত সভা করি যাতে কেউ কোন অন্যায়ের শিকার না হয়। এছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু স্বাস্থ্য, শিশু নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করে থাকি। এসব ক্ষেত্রে ইউনিয়নের সহযোগিতায় আমরা সমাধানও নিয়ে থাকি।
সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মজনুর রহমান মালী জানান, শিশু বান্ধব সমাজ গঠনে আমরা নিয়মিত কাজের পাশাপাশি শিশু ফোরাম গঠন করেছি। আর শিশু বান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আগরদাঁড়ী মহিলা মাদ্রাসা, আবাদেরহাট গার্লস স্কুল এবং হলদার বাড়ি পুকুরের পাশে মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হতো কিন্তু তা বন্ধ করেছি। আগরদাঁড়ি মহিলা মাদ্রসা ও বকচরা দাখিল মাদ্রাসাতে টয়লেট সংস্কার, আগরদাঁড়ি মাঝের পাড়া মোস্তাফা আমিনের বাড়ির পিছনের পুল ও ধলবাড়িয়া পুল সংস্কার, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, ইন্দিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরানদহা মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় পানির কল মেরামত, ওয়ার্ড ভিত্তিক খেলাধুলার উপকরণ বিতরণ, দরিদ্র ও অসহায় শিশুর পরিবারকে ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ড দেওয়া , প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাতার কার্ড দেয়া, স্কুল ও কমিউনিটি ক্লিনিক চলাকালিন সময়ে ভিজিট করা, খেলার মাঠ শিশুদের ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা, আগরদাঁড়ি পশ্চিমপাড়া বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টয়লেটের দরজা ও বøাক বোর্ড স্থাপন, বকচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে রাস্তা সংস্কারসহ নানাবিধ কাজ শিশুদের মতামতের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি।
এছাড়া তিনি আরও জানান, শিশুদের ওয়ার্ড সভা, প্রি-বাজেট সভা ও উন্মুক্ত বাজেট সভায় অংশগ্রহণ ও মতামত প্রদানের সুযোগ তৈরি করেছি। শিশুদের কল্যাণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরো ৪৪টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি যা চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়ন করবো।
আগরদাঁড়ী ইউনিয়নের পারিবারিক বিরোধ নিরসন, নারী ও শিশু বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি মোছা. রেহেনা খাতুন বলেন, শিশুদের সাথে নিয়মিত মাসিক সভায় আমরা মত বিনিময় করে থাকি। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মতামতের প্রতি গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সমস্যার উদ্ভব হলে তা সমাধানের চেষ্টা করি। আগামীতে তাদের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বাজেটও রাখার পরিকল্পনা করেছি।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের অফিস ইনচার্জ শরিফুল ইসলাম বলেন, শিশুদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার জন্যে গঠিত এসব ফোরামে সকল শ্রেণির শিশুদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিজ নিজ ইউনিয়নের শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে এসব ফোরাম ইতোমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।
এছাড়া তিনি এসব শিশু ফোরামের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী হয়ে বলেন, আমরা সকলে মিলে শিশু ফোরামকে সমৃদ্ধ করতে পারলে আগামীতে শিশুদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা অনেক সহজ হবে। একই সাথে শিশুদের যাবতীয় সমস্যা তারা নিজেরাই উদঘাটন করবে এবং তারাই সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে। একটি সচেতন জাতি গড়ে তোলার জন্যে- যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version