Site icon suprovatsatkhira.com

শব্দ দূষণে দুর্বিষহ জনজীবন: প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ

আলামিন পেশায় ছাত্র। মাত্র কিছুদিন হলো সে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে তাকে দিনের অধিকাংশ সময়ই টিউশনিতে থাকতে হয়। কলেজ সংলগ্ন একটি ছাত্রাবাসে থাকে সে। কিছুদিন পর তার পরীক্ষা। সে সারাদিন পর সন্ধ্যায় পড়তে বসেছে, ঠিক এমন সময়…
‘সুখবর, সুখবর, সুখবর; পোল্ট্রি মুরগীর দাম মাত্র ১০০ টাকা…’
ক্ষণিকের জন্য তার মনোযোগ বই থেকে বাইরে চলে গেলো। অবশ্য সে এগুলো শুনে শুনে অভ্যস্ত। কয়েক মিনিট পর পরিবেশ ঠাণ্ডা। আলামিন আবার খুব মন দিয়ে পড়তে বসল। কিন্তু আবার?
‘আর নয় ঢাকা-খুলনা, এখন সাতক্ষীরাতে প্রতি রবিবার সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নিয়মিত রোগী দেখছেন ঢাকা থেকে আগত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক…”
আলামিন মনোযোগ দিয়ে শুনে আর ভাবছে, শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা। ঢাকা থেকে ডাক্তার আসলে রোগীদের আর কষ্ট করে ঢাকায় যেতে হবে না, ভালই তো!
সে আবার পড়তে বসল, কিন্তু একি!
‘হ্যাঁ ভাই, আমাদের শো-রুমে পাচ্ছেন সকল প্রকার জুতার উপর আকষর্ণীয় মূল্য ছাড়…অফারটি সীমিত সময়ের জন্য…’
আলামিন এবার ভাবল, তার তো জুতার দরকার নেই। সুতরাং সে এবার নিজের কান বন্ধ করে শব্দ না শোনার বৃথা চেষ্টা করল।
এবার সে ভাবল-যাক বাবা, মোটামুটি রাত হয়েছে। আর কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। সে পদার্থ বিজ্ঞানের জটিল সব থিউরি আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে, এমন সময়…
‘ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকের জন্য সুখবর (ছাত্র শব্দটা শুনতেই আলামিন খুব মনোযোগ দিল) আমাদের এখানে অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করা হইতেছে, আজই যোগাযোগ করুন…’
সাতক্ষীরাতে থাকেন আর আলামিনের মতো শব্দ দূষণের কবলে পড়েন নি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতো গেলো আবাসিক এলাকার দৃশ্য, একটু শহরের দিকে ফিরতে চাই।
যানবাহনের হর্ন সাতক্ষীরাবাসীর জন্যে নিত্যদিনের যন্ত্রণা। এ ব্যাপারে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে। সব ধরনের যানবাহন, বিশেষ করে ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্নের আওয়াজ শহরের শব্দদূষণকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে আছে আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত মেশিনের শব্দ; যা ক্রমাগত অসুস্থ করে তুলছে বৃদ্ধ ও শিশুদের। এমন কী শ্রবণ শক্তি হারাতে বসেছে অনেক শিশু।
যানবাহনের হর্ণ বাজানো নিয়ে কড়াকড়ি আইন থাকলেও জেলায় এর কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালের সামনে দিয়ে বিকট শব্দে হর্ণ বাজিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলেও তা দেখার কেউ নেই। জেলার অধিকাংশ মানুষের শব্দদূষণের ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা নাই। একই সঙ্গে সমাজে সচেতনতার বড়ই অভাব রয়েছে। আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং সচেতনতার অভাবে শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ-এর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০টি বড় রোগের কারণ ১২ ধরণের পরিবেশ দূষণ। তার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। যা মানুষের শারীরিক-মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ।
জেলার হাসপাতাল মোড়ে জ্যামের কারণে অনবরত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে বাস ড্রাইভার জুলফিকার। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে ড্রাইভারি করি, আইনকানুন সব জানি। কিন্তু এই দ্যাশে এসব নিয়ম চলব না।
তিনি আরো বলেন, “হর্ণ না দিলে অন্য ড্রাইভাররা শুনতে পাবে না। রাস্তায় অনেক বেশি শব্দের কারণে আমাদেরও জোরে হর্ণ বাজাতে হয়। রাস্তায় শব্দ কম থাকলে আস্তে হর্ন বাজালেও পাবলিক শুনত।”
শহরের পলাশপোল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মঙ্গল কুমার পাল মনে করেন, শব্দ দূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং শব্দ দূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারি ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। কোথায় যাবেন, কাকে অভিযোগ করবেন?
২০০৬ সালের শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, শব্দের মান-মাত্রা অতিক্রম করা যন্ত্রপাতি যেমন মাইক, লাউড স্পিকার, এমপ্লিফায়ার, মেগাফোন শব্দ বর্ধনের জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা অন্য কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার আইনত দ-নীয় অপরাধ। আবাসিক এলাকা ব্যতীত অন্য এলাকায় শব্দের মান-মাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন হবে। যার জন্য ৩ দিন আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দরখাস্ত করতে হবে।
গেজেটে উল্লেখ আছে, উপজেলায় এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার অথবা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর জেলা সদরে বিষয়টির দেখভাল করবেন জেলা প্রশাসক অথবা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
শব্দ দূষণ প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন- এমনটাই প্রত্যাশা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version