Site icon suprovatsatkhira.com

পাগলা কানু অবশেষে পাগল হয়ে গেলো

মনিরুজ্জামান ছট্টু

আমাদের গ্রামে কবি আসবেন। একজন কবি না, অনেক কবি। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকে যেখান দিয়ে ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ, যাকে আমরা এখন মরা কপোতাক্ষ বলি-তার তীরে যে বড় বট গাছটা, তার তলায় নাকি কবিদের মিলন মেলা হবে। ভাসা ভাসা এমন কথা এখন গ্রামে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এমন আলোচনায় আমাদের তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও একজনের আগ্রহের কিন্তু মোটেই কমতি ছিল না। সে হলো আমাদের পাগলা কানু। বটতলায় কবিদের মিলন মেলা হবে। মিলন মেলা জিনিসটা যে আসলে কী রকম সে সম্পর্কে পাগলা কানুর কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কারা এর আয়োজন করছে, কারা এসব কবিদের আমাদের এই অজগাঁয়ে নিয়ে আসছেন, তার কোন কিছুই পাগলা কানু জানে না। সে শুধু শুনেছে, আমাদের গ্রামে কবি আসবেন। একজন কবি না, অনেক কবি। বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে যেসব কবিদের কবিতা ছাপা হয়, যাদের নাম ছাপা হয়, সে রকম সত্যিকারের কবি। পাগলা কানু নিজেও একজন কবি। আমাদের এই মরা কপোতাক্ষ তীরের কাঁটাখালি গ্রামের সবাই তাকে চিনি পাগলা কবি হিসাবে। কিন্তু তার কবিতা কখনো বইয়ের পাতায় ছাপা হয় না। সে তো আর লেখাপড়া জানে না। তাই সে লিখতেও পারে না। তবে মুখে মুখে সে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর কবিতা বানাতে পারে। আমরা তার কবিতা শুনে মুগ্ধ। তবে এই যে কবিতা বানানো, এ কিন্তু সবসময়ের জন্য না। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় তার মাথা খারাপ থাকে। বিশেষ করে গরমের সময়। শীতকালে একটু ভালো থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সে যখন ভালো থাকে তখন সে একটাও কবিতা বানাতে পারে না। চৈত্র-বৈশাখ মাসে যখন গণগনে সূর্য আগুনের ফুলকি ছড়ায় চরাচরময়, তখন তার কাব্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে।
‘মাটিতে গাছ, উপরে আকাশ,
তার নিচে আমাদের বসবাস।’
অথবা-
‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়
পান্তা আনতে নুন,
পিঁপড়ের মুখে খুদ দেখে বৌ
হেসেই হলো খুন।’
পাগল অবস্থায় আমাদের পাগলা কানু এরকম অজস্র কবিতা বানাতে পারে। সে যখন ভালো থাকে তখন কিন্তু এরকম একটাও কবিতা বানাতে পারে না। একবার মাঘের প্রচÐ শীতে তাকে আমরা চেপে ধরলাম কবিতা শুনব বলে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে আমাদের একটাও কবিতা শোনাতে পারল না। যেহেতু তখন শীতকাল এবং পুরোপুরি সে সুস্থ, তাই সে নিজেই স্বীকার করল-‘আমি জানি আমি অনেক কবিতা বানাতে পারি, তোমরা তো আমাকে কবি বলে ডাকো, কিন্তু কি করব-এত চেষ্টা করছি, আমার মাথায় তো একটাও কবিতা আসে না।’
আমাদের গ্রামের কবি কানাইলাল দত্ত ওরফে পাগলা কানু, পাগলা হলেও সে কিন্তু খুবই ঠাণ্ডা ও নিরীহ স্বভাবের। শীত মৌসুমে পাগলা কানু পুরোপুরি সুস্থ। সে যে পাগল তা বোঝার কোন উপায়ই থাকে না। একেবারেই স্বাভাবিক। খায় দায়, ঘুরে বেড়ায়, গল্প করে। এমনকি ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের সামনে যে ক্লাবঘর, সেখানে সে আর পাঁচজনের সঙ্গে ক্যারাম বোর্ড খেলে। সেও যেমন গ্রামের সবারই সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে, গ্রামের প্রত্যেকেই তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। পাগল বলে তাকে কেউই খ্যাপায় না বা খারাপ আচরণ করে না। তাকে কবি বললে বা পাগলা কবি বললে রাগ তো করেই না, বরং আরও খুশি হয়। তার নিজের মধ্যে এক ধরণের দৃঢ় ও স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে সে লিখতে না পারলেও সে একজন কবি। আর এ কারণেই কপোতাক্ষ পাড়ের বটতলায় যে কবিদের মিলন মেলা হবে, সেটা নিয়ে তার উৎসাহের শেষ নেই। যাকে পায়, তাকেই জিজ্ঞাসা করে-‘কবে আসবে কবি? কবে হবে সেই অনুষ্ঠান?’
আসলে এ ব্যাপারে আমরাই বা আর জানি কতটুকু? কানাঘুষা চলছে, টুকরা-টাকরা কথা ভেসে আসছে কাঁটাখালি গ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেই ভেসে আসা টুকরো কথার সারমর্ম আমরা যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি তা হলো-যশোরের ঝিকরগাছায় কে একজন সাহিত্যিক আছেন, তিনিই নাকি এর আয়োজন করছেন। তার আমন্ত্রণেই ঢাকা থেকে বা দেশের অন্যান্য জেলা থেকে কবি সাহিত্যিকরা আসবেন। আসলে এইসব সাহিত্য টাহিত্য’র ব্যাপারে আমাদের উৎসাহ বা আগ্রহ খুবই কম। তবে ইদানিং একটু একটু আগ্রহ বাড়ছে আমাদের কারুর কারুর। আগ্রহ বাড়ার একমাত্র কারণ যদিও আমাদের গ্রামের একমাত্র কবি কানাইলাল দত্ত, আমাদের পাগলা কানু। তার সীমাহীন উৎসাহ আর আগ্রহ আমাদেরকেও খানিকটা উৎসাহিত করল। বিশেষ করে পাগলা কানুর কথার সূত্র ধরে আমরা এটা বুঝলাম যে, আমাদের এই গ্রামে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেশ কিছু সম্মানিত লোক আসবেন। তারা আমাদের মেহমান। তাদেরকে সম্মান জানানো, তাদেরকে আপ্যায়িত করা আমাদের দায়িত্ব। কারণ এর সাথে আমাদের গ্রামের মান-সম্মান জড়িত। পাগলা কানু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আসলে ব্যাপারটা আমরা এভাবে ভেবে দেখিনি। এখন নতুন করে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। গ্রামের একজন ঝিকরগাছা গেল সেই সাহিত্যিক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে। ঝিকরগাছা থেকে ফিরে আসার পর আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেলাম। দিন, তারিখ, স্থান, অনুষ্ঠানের ধরণ সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা তৈরি হবার পর আমরা অর্থাৎ ‘সূর্য তরুণ উদয়ন সংঘে’র সকল সভ্যরা মাঠে নেমে গেলাম। তবে উৎসাহ আর আমাদের কী? উৎসাহ তো আমাদের পাগলা কানুর।
সে গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে, প্রত্যেকটি মানুষের কাছে অনুষ্ঠানের দাওয়াত পৌঁছে দিল। অনুষ্ঠান কেমন হবে, কিভাবে হবে, এ সম্পর্কে তার কোন ধারণা না থাকলেও সে শুধু জানে তাদের গ্রামে কবি আসবেন, একজন কবি না, অনেক কবি। বইয়ের পাতায় যাদের কবিতা ছাপা হয়, নাম ছাপা হয়, সে রকম সত্যিকারের কবি। তাদের গ্রামে এর আগে আর কোনদিন কোনো কবি আসেনি। তার মাথা খারাপ বলে তার বাড়ির লোক তাকে এ গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও কোনদিন নিয়েও যায়নি। শুধু দু’বার ইন্ডিয়া গেছে-তাও চিকিৎসার জন্য। সেখানে সে কেবল মানুষ দেখেছে, হাজার হাজার মানুষ। গাড়ি দেখেছে, আকাশ সমান উঁচু উঁচু বাড়ি দেখেছে, দেখেছে ডাক্তার। কবি তো আর দেখিনি। তাই কবি দেখার আনন্দে সে এখন বিভোর থাকে সবসময়। এই অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে কোন কাজ দেওয়া হয়নি, কোনো দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। তবু তারই যেন সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। কবিরা কোথায় বসবেন, কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন, তাদেরকে কী কী খাওয়াতে হবে-এরকম অসংখ্য প্রশ্নবানে সে পুরো গ্রামবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলল। যেহেতু গ্রামের সবাই তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, সেহেতু তার প্রতি কেউ বিরক্তি প্রকাশ করল না। তবে পাগলা কানুর এই মহা উৎসাহের কারণে একটা লাভ হলো। পুরো গ্রামবাসী জেনে গেলো যে, গ্রামে কিছু একটা হচ্ছে। কী হচ্ছে, কী হবে বটতলার বঙ্গবন্ধু পার্কেÑএই কৌত‚হলটা জাগাতে সমর্থ হলো সে। যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, সেই বিষয়টি নিয়ে শুধু আমরা যারা ক্লাবের সভ্য, কেবল তারাই নয়, পুরো গ্রামবাসীর মধ্য শুধু আগ্রহ নয়, এক ধরনের দায়বোধও তৈরি হলো। আর এর সবকিছুর মূলে কিন্তু আমাদের পাগলা কানু।
এখন শীতকাল। শীতকালে পাগলা কানুর পাগলামি থাকে না। আর পাগলামি না থাকলে তার মাথা থেকে কবিতাও বেরোয় না। পাগলামিও নেই, কবিতাও নেই। তবু পাগলা কানুর যেন উৎসাহের শেষ নেই।
আজ সেই কাক্সিক্ষত কবি মেলা। আমাদের কাঁটাখালি গ্রাম যেন নতুন করে জেগে উঠেছে। আজ আর অন্য কোনো কাজ নেই কারু। কৃষক মাঠে যায়নি কাজ করতে, এসেছে এই কপোতাক্ষ পাড়ের বটতলায়। ভ্যানওয়ালা তার ভ্যান বের করেনি। দিনমজুর কাজে যায়নি। ছুটির দিন বলে স্কুল কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দও এসে হাজির হয়েছে এই কবি মেলায়। গৃহিনীরা-যাদের মেহমানদের খাওয়ানোর দায়িত্ব তারা মহা উৎসাহে রান্না চাপিয়েছে সকাল সকাল। বাকীরা ভোর ভোর উঠে রান্না বান্না শেষ করে খেয়ে দেয়ে চলে এসেছে বটতলায়। সকাল দশটা না বাজতেই বটতলার বঙ্গবন্ধু পার্ক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো। বিচ্ছিন্নভাবে যে দু’একজন কাজে বেরিয়েছিল, তারাও কাজ ফেলে চলে এসেছে। যে কৃষক মাঠে ধান কাটছিলো, কাস্তে হাতে চলে এসেছে বটতলায়। যে ভ্যানওয়ালা দু’একটা ভাড়ার আশায় বেরিয়েছিল রাস্তায়, সেও তার ভ্যান নিয়ে চলে এসেছে বটতলায়। বাড়ির বৌরা, মেয়েরা বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসে পড়েছে। মাত্র শ’পাচেক চেয়ারের ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র পাচশ’ চেয়ার! সে আর কতক্ষণ? তাই কেবল মেহমানরাই বসল চেয়ারে। গ্রামবাসী বসে পড়ল মাটিতে। বটতলা ততক্ষণে লোকে লোকারণ্য। আশপাশের আরও দু’দশটা গ্রাম থেকে লোক চলে এসেছে। যদিও তারা অধিকাংশই এসেছে মেলা দেখতে। কিসের মেলা, কি জন্য তা তারা জানে না। আর এসেছে বেশ কিছু দোকানপাট। মেলাস্থলের পূব পাশে যেখানটায় বট তার ডালপালা দিয়ে খুব একটা ছায়া দিতে পারেনি, সেখানে বসেছে খেলনার দোকান। এর পাশাপাশি বসেছে চুড়ি, ফিতে, আলতা, ¯েœার মনোহারী দোকান। সংসারে নিত্য দরকার-এমন দোকানও বসেছে বেশ কটা। এর মধ্যে ঝুড়ি, কুলো, ধামা, রুটি বেলা ব্যালন, পিঁড়ে, কাঠের চৌকি বিক্রি হচ্ছে দেদার। এসব দোকানগুলোতে উপছে পড়া ভিড়। একেবারে নদীর ধার ঘেসে বসেছে খাবারের দোকান। সেখানেও লোকের কমতি নেই। আমাদের গ্রামের একমাত্র কামার, দীনেশ কর্মকার, যার খুব একটা পসার নেই; সেও চলে এসেছে। সে খুব একটা ভালো জায়গা না পেয়ে দক্ষিণ দিকে বিল লাগোয়া একজনের চষা জমিতে চট বিছিয়ে বসে পড়েছে। দা, বটি, কোদাল, শাবল, নিড়ানী, ছুরিসহ হরেক রকম লোহার তৈরী জিনিস নিয়ে বসেছে সে। গ্রামের লোক সবাই জানে দীনেশ কামারের তৈরি জিনিস খুব একটা ভালো হয় না, তারপরেও আজ কিন্তু তার ভালোই বিক্রি বাটা হচ্ছে। গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে অল্প বয়সী কিছু ছেলে বিক্রি করছিল বাদাম, ছোলা ভাজা, আঙুর, আপেল, কমলা, পান, বিড়ি-সিগারেটসহ বেশ কিছু সামগ্রী। অনুষ্ঠানস্থলের মধ্য ঘুরে ঘুরে তারা তাদের সামগ্রী বিক্রি করায় অনুষ্ঠানের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে আমরা তাদের মাঠের উত্তর দিকে, যেখানে ছোট একটা শিরিস গাছ, তার তলায় জায়গা করে দিয়েছি।
হাজারো মানুষের কোলাহল, শিশুদের হুল্লোড়, হৈ চৈ, চেচামেচিÑমূল অনুষ্ঠানের যাতে কোনো ব্যঘাত না ঘটে তার জন্য আমাদের ‘সূর্যতরুণ উদয়ন সংঘে’র অন্ততঃ শ’খানেক সদস্য অত্যন্ত তৎপর। তৎপর আমাদের পাগলা কানুও। কোন শিশু চেচামেচি করলে বা কেঁদে উঠলে দৌঁড়ে সে সেখানে চলে যাচ্ছে। কেউ জোরে কথা বললে, দৌড়ে সে সেখানে যেয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘মা সকলরা, বাবা সকলরা, কবিতা শোনেন, কথা বলবেন না’।
আমাদের মঞ্চ সজ্জা খুবই সাদামাটা। চার পাশটা ফাঁকা। কোথাও কোনো আড়াল নেই। মাথার উপর কোনো শামিয়ানা নেই। কেবল বটের ঘন পাতার ছাওয়া আচ্ছাদন। আমন্ত্রিত কবিরা যেখানে বসেছে, কেবল তার সামনে দুটো টেবিল পাতা। পেছনে একটা সাদা কাপড় আর কাপড়ের উপর একটা ব্যানার। পাশে ছোট্ট একটা ডায়াস। ডায়াসে দাঁড়িয়ে কবিরা কবিতা পড়ছেন। সঞ্চালক যে, সে আমাদের গ্রামেরই ছেলে। এখন ঢাকায় থাকে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে চলে এসেছে। সঞ্চালক এক একজন কবি সম্পর্কে দু’একটি কথা বলে তাকে মঞ্চে আহŸান করছেন। আমরা খুবই ঔৎসুক্য কারণ সঞ্চালকের কাছে আমাদের পাগলা কানুর নাম দেওয়া আছে। পাগলা কানু সম্পর্কে দু’একটি কথা নয় বরং বেশ কিছু কথা বলবে সে। তারপর তাকে কবিতা পড়ার জন্য আহŸান জানাবে। আমরা ক্লাবঘরে তাকে রিহার্সাল করিয়েছি। সে তার বাঁধা কবিতা থেকে বেশ কয়েকটি কবিতা পড়বে। আমরা জানি সে যখন ভালো থাকে তখন তার মাথা থেকে একটাও নতুন কবিতা বের হয় না। এখন শীতকাল, আবহাওয়া ঠাÐা, তাই তার মাথাও ঠাণ্ডা। মাথা ঠাণ্ডা থাকলে তার পাগলামিও থাকে না। আর পাগলামি না থাকলে কবিতাও থাকে না। তবু তার মুখে নতুন বানানো কবিতা থেকে আমরাই কিছু কবিতা নতুন করে মুখস্থ করিয়েছি। যেগুলো সে আজ পড়বে। আমরা খুবই নিশ্চিত ছিলাম এই ভেবে যে, তার কবিতা শুনলে সবাই অবাক হয়ে যাবে। একেবারে নিরক্ষর একজন মানুষ যে এমন চমৎকার কবিতা বানাতে পারে, না শুনলে তা কেউ বিশ্বাস করবে না। আমাদের স্থির ও দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, অনুষ্ঠানে আগত খ্যাতিমান কবিরাও তার কবিতা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না।
হঠাৎ একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল। খুবই সাধারণ এবং খুবই ছোট। তখন ঢাকা থেকে আগত একজন কবি কবিতা পড়ছেন। তার ভরাট কণ্ঠের কবিতা পাঠ আমাদেরকে মোহিত করে তুলছে। আমরা তখন সবাই মনোযোগী শ্রোতা।
‘একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য সে কি ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের; কখন আসবে কবি?
কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।’
হঠাৎ পাগলা কানুর তীব্র চিৎকার। সে চিৎকার এমনই তীক্ষè আর আর্তনাদের মত শোনাল যে, কবির কবিতা পাঠ থেমে গেল। মাঠের সমস্ত মনোযোগী শ্রোতার দৃষ্টি গেল পাগলা কানুর দিকে। এমন চমৎকার কবিতা শোনার ব্যঘাত ঘটায় কেউ কেউ তেড়ে গেল তার দিকে। আমরা খুব দ্রুত তার কাছে গেলাম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা প্রকৃত ঘটনা উদ্ধার করে ফেললাম। সাতক্ষীরা থেকে আগত একজন কবির মাথায় একটা পাখি মলত্যাগ করেছে। ঘটনা খুবই ছোট। কবি বিব্রত ভংগিতে পকেট থেকে রুমাল বের করে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। এ দৃশ্য আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ঘটনা। পাখিরা এমন কাজ করতেই পারে, আর গাছ তলায় থাকলে কারুর না কারুর গায়ে মাথায় লাগতেই পারে। এটা সত্যি সত্যি একটা তুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু আমাদের পাগলা কানু- সে কিন্তু এটাকে তুচ্ছ ঘটনা বলে মেনে নিতে পারল না। সে তখন ক্রমান্বয়ে চিৎকার করে উঠছে আর বলছে, ‘তোর এত বড় সাহস, কবির মাথায় হাগিস?’ সে মাঠ থেকে কিছু ঢিল তুলে গাছের দিকে ছোড়া শুরু করল। ঢিলের আঘাতে গাছের পাখিরা ওড়া শুরু করল বিক্ষিপ্তভাবে। পাগলা কানুর ছোড়া একটা ঢিল গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে নিচে একটা শিশুর মাথায় এসে পড়ল। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মানুষজন উঠে দাঁড়ালো। ইতস্ততঃ হাঁটাহাঁটি শুরু করল। শিশুরা দৌঁড়ঝাপ শুরু করল। কথা বলা শুরু করল দু’একজন। সে কথা পুরো মাঠময় সংক্রামিত হয়ে রীতিমত চিৎকার চেচামেচিতে পরিণত হয়ে গেল। ততক্ষণে অনুষ্ঠান পÐ। সঞ্চালক মাইক্রোফোন হাতে জনতাকে ধৈর্য ধরার আহŸান জানাচ্ছেন। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। আমরা খুব দ্রæত পাগলা কানুর হাত থেকে ঢিল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করলাম তাকে ধরে মাঠের বাইরে নিয়ে যেতে। যাতে আমরা আবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। কারণ সে ততক্ষণে নিজেই ছোটা শুরু করেছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাছ থেকে ওড়া পাখিগুলোর পিছে পিছে ছুটছে আর বিড়বিড় করে বলছে, ছি! ছি! কী লজ্জা! শেষে কীনা কবির মাথায়। ছি! ছি! কী লজ্জা! শেষে কীনা কবির মাথায়…।’
আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কানু মাঠ ছেড়ে চলে গেছে। সঞ্চালক মাইক্রোফোন হাতে আবার অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা দিলেন। আগের মতো প্রাণ ফিরে না এলেও অনুষ্ঠান শুরু হলো এবং শেষও হলো একসময়।
আর আমাদের পাগলা কানু! আমাদের কবি প্রাণ কবি কানাইলাল দত্ত! তার অবস্থা কী এখন? দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও তার মাথা আর ঠিক হয়নি।
আগে শীতকালে তার মাথা ঠাÐা থাকত। তখন তার কোনো পাগলামি থাকত না। এখন বছরের বারো মাসই তার মাথা খারাপ থাকে। আগে মাথা খারাপ থাকলে সে চমৎকার চমৎকার কবিতা বানাতে পারত। এখন সে একটাও কবিতা বানাতে পারে না। সারাক্ষণ সে কেবল বিড় বিড় করে বলে, ‘ছি! ছি! কী লজ্জা! ছি! ছি! কী লজ্জা! ছি! ছি! কী লজ্জা! ছি! ছি! কী লজ্জা!…।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version