জেলে-বাওয়ালীদের বাঁচাতেই দস্যুদের আত্মসমর্পণ.. প্রান্তিক জেলে-বাওয়ালীদের অর্থনৈতিক মুক্তিই প্রধান লক্ষ্য.. বনদস্যু-জলদস্যুদের প্রতি অনুকম্পা নয়; দস্যুতা থেকে সুন্দরবন উপকূলের জেলে-বাওয়ালীদের মুক্তি দিতেই সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ…….. সামগ্রিক বিষয়ে লিখেছেন বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্যস্ততাকারী যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম
মাস্টার বাহিনীর নাম মনে আছে? দুই বছর আগেও সুন্দরবন আর সাগরের জেলেদের কাছে দুর্ভাগ্যের আরেক নাম ছিল মাস্টার বাহিনী। মাসে অন্তত দুই বার সাগর থেকে জেলেদের অপহরণ করতো এই জলদস্যু বাহিনী। সমসাময়িক আরও অন্তত দেড় ডজন দস্যুবাহিনীর দাপটে তখন সন্ত্রস্ত সুন্দরবনের খাল নদী। এক কথায় বনের এ মাথা থেকে ও মাথা দখলে ছিল কোনও না কোনও দস্যুবাহিনীর। আর তাদের হাতে জিম্মি ছিল বন-উপকূলের প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ। কুখ্যাত মাস্টার বাহিনীর প্রধান ছিলেন বাগেরহাটের রামপালের মোস্তফা শেখ। দুই বছর আগে র্যাব এর মাধ্যমে তিনি দলের সদস্যদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জমা দেন ৫২টি অস্ত্র ও সাড়ে পাঁচ হাজার গুলি। পুরো আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্ততা করেছিলাম আমরা। অস্ত্র ছেড়ে সেই কুখ্যাত বনদস্যু মোস্তফা শেখ এখন হাতে নিয়েছেন মটরসাইকেল সারানোর যন্ত্রপাতি। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কাটছে নিরিবিলি জীবন। বাগেরহাটে মটরসাইকেল মেরামতের একটি দোকান দিয়েছেন তিনি। সেই আয় দিয়েই চলছে এক সময়ের দস্যুনেতা মোস্তফা শেখ এর সংসার। এই দুর্ধর্ষ লোকটিই প্রথম আত্মসমর্পণে এগিয়ে এসেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় দুই বছরে আত্মসমর্পণ করেছে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬টি দস্যু বাহিনী। অস্ত্র ছেড়ে তাদের কেউ আবারও জাল হাতে নিয়েছে, কেউ বা দিন মজুরের কাজ করছে। সাবেক দস্যুনেতা মুন্সীগঞ্জের আলম এখন ইজি বাইক চালান। পূর্ব সুন্দরবনের দস্যু শান্ত বাহিনীর প্রধান বারেক তালুকদার চালান একটি মুদির দোকান। ইলিয়াস বাহিনীর প্রধান ইলিয়াস ডুমুরিয়ায় মাছের ঘের করেছেন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে কাটাচ্ছেন নিরিবিলি জীবন। মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু করছেন মাছের ব্যবসা। এদিকে নোয়া বাহিনীর প্রধান নোয়া মিয়াও ঘের নিয়ে মাছের ব্যবসা করছেন। ঘের নিয়ে মাছের কারবার করছেন সাগর বাহিনীর প্রধান আলমগীর। ছোট রাজু বাহিনীর প্রধান রাজু এখন পুরোদস্তুর জেলে। বড় ভাই বাহিনীর প্রধান ওহিদ মোল্লা কদিন আগে জেল থেকে বের হয়েছেন। সরকারের দেয়া সহযোগিতা নিয়ে চলছেন তিনি। আলিফ বাহিনীর প্রধান আলিফ ক’দিন আগে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন তিনি সতের বছর পর। বিভিন্ন দস্যুবাহিনীর সদস্যরা যার যার বাড়িতে ফিরেছে। যে যার মত করে কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া অনুদান, বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের অনুদান ও র্যাব এর সহযোগিতায় কেউ বা ছোট খাট ব্যবসা করছে, কেউ কেউ রিকসা, ভ্যান বা মটরসাইকেল চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। এক কথায় দস্যুতা ছেড়ে তারা জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। আশার কথা, দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের একজনও ফিরে যায়নি আগের দস্যু জীবনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাচ্ছে তারা। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় নতুন করে জীবন সাজাচ্ছে ভয়ংকর সেই বনদস্যুরা। সুন্দরবনের দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। র্যাব মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত হয় টাস্কফোর্স। একের পর এক অভিযানে অনেকেই ধরা পড়েছে। কারও কারও প্রাণ গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। সেই অভিযানের চাপে কোণঠাসা হতে থাকে বনের ভেতরে অবস্থানরত দস্যুরা। এর আগে সুন্দরবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত এক রকম দস্যুদের দখলেই ছিল। সাগর আর বনের নদী-খালে মাছ ধরতে আগাম চাঁদা দিতে হতো। আর চাঁদা না দিলে প্রতি গোন-এ (প্রতি পক্ষে মাছ ধরার সময়) বনের খাল-নদী আর বঙ্গোপসাগর থেকে শত শত জেলেদের জিম্মি করত দস্যুরা। উপকূলীয় জনপদ ও দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সুন্দরবন ঘেঁসা জনপদের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের নাম ছিল বনদস্যু-জলদস্যু। বাস্তবতা অনুধাবন করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত হয় বনদস্যু-জলদস্যু প্রতিরোধে বিশেষ টাস্কফোর্স। পাশাপাশি বনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হয় কোস্টগার্ডের সক্ষমতা। সীমান্ত নদীতে জোরদার করা হয় বিজিবি’র তৎপরতা। সব মিলিয়ে দস্যুদের অবাধ বিচরণ কমে আসে। এদিকে অনেক বনদস্যু ধরা পড়ে লোকালয় থেকে। বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারায় বেশ কয়েকজন দস্যু প্রধানসহ একশ’র বেশী বনদস্যু। জলদস্যু-বনদস্যুরা তখন সব মিলিয়ে বেশ কোণঠাসা। তার পরও দস্যুতা কমছিল না। তখন বনের ভেতরে জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণ নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে মুক্তিপণের টাকার পরিমান। দস্যুদের অনেকে ধরা পড়লেও বনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সংগঠিত দস্যু বাহিনীগুলো তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যায়। এর বড় কারণ ছিলো সুন্দরবনের দুর্গমতা। এছাড়া নদী পথ ছাড়া আর কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় দ্রুততম সময়ে অভিযান চালানোর কোন সুযোগ ছিল না, এখনও নেই। কারণ, জোয়ার ভাটার হিসেব করেই বনের ভেতরে চলাফেরা করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দস্যুরা মুখোমুখি হলেও তারা বনের গভীরে পালিয়ে যায়। তখন দস্যুদের ফেলে যাওয়া নৌকা আর কিছু ব্যবহারের জিনিসপত্র ছাড়া তেমন কিছু ধরা পড়ে না। অস্ত্র-গুলি দস্যুদের যার যার হেফাজতে থাকে। তাই দস্যুদের ধরতে না পারলে তাদের ব্যবহারের অস্ত্র গোলাবারুদও সাধারণত ধরা পড়ে না। সব মিলিয়ে বনের দুর্গম পরিবেশের সুযোগ নিয়ে কোণঠাসা দস্যুরা জেলে বাওয়ালীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বহাল রাখে। তাই চলমান দস্যুবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি দস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর চিন্তা মাথায় আসে তখন থেকেই। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে কতটুকুই বা করার ছিল আমার? তারপরও মাঠের বাস্তবতা মাথায় নিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে থাকি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলার পর যখন সাতক্ষীরার গাবুর-পদ্মপুকুর-এ কাজ করতে যাই, তখন থেকেই এই ধারণাটি মাথায় আসে। আইলার পর লণ্ডভণ্ড গাবুরার চকবারার অনেকেই সেদিন বলছিলেন দস্যুদের নির্যাতনের কথা। ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর তখন শুধুই থাকা খাওয়ার সমস্যার কথা বলার কথা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বনদস্যুদের নির্যাতনের কথা শুনে বিষয়টি আমার ভাবনায় আসে। সেদিন চকবারার মহসিন বলছিলেন, বনঘেঁসা সেই জনপদের মানুষ তখন মাছ ধরতে বনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কারণ, দস্যুদের আগাম টাকা বা মুক্তিপণ দেয়ার ক্ষমতা তখন ছিল না সব হারানো আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের। সে সময়ের দস্যু মান্নান বাহিনী, মোতালেব বাহিনী, আলিফ বাহিনীসহ পাঁচটি দস্যুবাহিনী তখন সাতক্ষীরা সুন্দরবনের ত্রাস। কিছুদিন পর আবারও সেই অঞ্চলে যাই। আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে ফলোআপ নিউজ করতে। সেবার দস্যু বাহিনীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। এটিএন নিউজ-এর সাতক্ষীরা জেলার সহকর্মী জামান ভাই এর পরামর্শে কথা বলি শ্যামনগরের সাংবাদিক সালাহউদ্দীন বাপ্পী ভাই এর সঙ্গে। তিনি সে সময়ের বড় দস্যু বাহিনী মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। মোতালেব এর সঙ্গে সেবার প্রায় ৪৪ মিনিট কথা হয়েছিল। এসময় তাঁর দস্যুতায় আসার কারণ, দস্যু জীবন তাদের কাটে কী করে, দস্যুতা ছাড়তে চান কী না.. এসব নিয়ে কথা হলো পুরোটা সময়। দুর্ধর্ষ দস্যু নেতা মোতালেব বললেন, নিজের বাড়িতে ফিরতে চান তিনি। নিরাপদ আত্মসমর্পণের সুযোগ পেলে শুধু তিনি না, বনদস্যুদের সবাই আত্মসমর্পণ করবে। এরপর থেকে রাজু বাহিনীর রাজু, জুলফু বাহিনীর প্রধান জুলফিকার, আলিফ বাহিনীর প্রধান আলিফ, মুকুল বাহিনীর প্রধান মুকুলসহ সব দস্যুনেতাই আমার কাছে আত্মসমর্পণে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তখন এনিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। পরবর্তীতে রাজু বাহিনীর আত্মসমর্পণের আবেদন নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করি। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অনাগ্রহে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে অনেক বনদস্যু বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আবার অনেকে প্রাণভয়ে পালিয়েছে। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সেখানেই থমকে যায়। এরপরও লেগে থাকি। ছয় বছরের চেষ্টায় সফলতার মুখ দেখেছে সেই উদ্যোগ। ২০১৬ সালের ৩১ মে ইতিহাসের প্রথম বারের মত সুন্দরবনের একটি দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। র্যাব মহাপরিচালক এবং জলদস্যু-বনদস্যু প্রতিরোধে টাস্কফোর্স প্রধান বেনজীর আহমেদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে সে সময়ের সবচেয়ে বড় দস্যু মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তারপর থেকে বঙ্গোপসাগর প্রায় শতভাগ দস্যুমুক্ত। দস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজে আন্তরিকভাবে কাজ করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আরও ২৫টি দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। তারপরও কয়েকটি দস্যুবাহিনী এখনও সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থান করছে। বনের ভেতরের কিছু কিছু খাল-নদী এখনও সেই দস্যুদের দখলে। এখন বড় চ্যালেঞ্জ এই ছোট ছোট দস্যুবাহিনীগুলোই। বনজীবীদের জীবন নিরাপদ করতে হলে নির্মূল করতে হবে তাদের। অথবা আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই সুন্দরবনকে করতে হবে দস্যুমুক্ত। পুরো কাজটি করতে গিয়ে অনেক রকমের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাদের। হিংস্র প্রাণির আক্রমণের শংকা যেমন ছিল, তেমনি প্রতিপক্ষ দস্যুদের আক্রমণের ঝুঁকিও ছিল পদে পদে। এছাড়া বনের ভেতরে অবস্থানরত দস্যুদের ওপর যেকোন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার আশংকা সব সময়ই ছিলো। কারণ, আমরা লুকিয়ে সবার চোখ আড়াল করে দস্যুদের কাছে যেতাম। একবার মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কোস্টগার্ডের গুলির মুখেও পড়তে হয়েছিল। তুমূল গোলাগুলির মধ্যে এক পর্যায়ে কোস্টগার্ড সরে যায়। সেই সুযোগে আমরা পালিয়ে আসি। এধরণের ঝুঁকির মধ্যেও আমাদের কাজ এগিয়ে গেছে। আমার সহকর্মী বায়েজিদ ইসলাম পলিন, সাতক্ষীরার আহাসানুর রহমান রাজীব, বাগেরহাটের ইয়ামিন আলী, খুলনার কনক রহমান, মোংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনসহ অসংখ্য সাংবাদিকের সহযোগিতা পেয়েছি। মংলার চিলার বেলায়াত সরদারের ট্রলারে করে ঘুরেছি প্রায় পুরো সুন্দরবন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা ছিল উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়েই মাঠ পর্যায়ের কাজটি সফল হয়েছে। অন্যদিকে যার নাম না নিলেই নয়, তিনি র্যাব-৮ এর সাবেক উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর। প্রথম কাজটি আমরা একসঙ্গে করেছিলাম। বাকী কাজটুকু হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায়। পেছন থেকে দস্যুদের আত্মসমর্পণে সার্বিক সমর্থন দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এরই মধ্যে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘোষণা দিয়েছেন এ বছরের মধ্যেই সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা হবে। হয়তো সেই ঘোষণার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব শিগগিরি। তবে আমি এনিয়ে শংকিত। কারণ, বড় ও মাঝারি দস্যু বাহিনীগুলোর আত্মসমর্পণের পর এতগুলো দস্যুবাহিনী থাকে কী করে? এই প্রশ্ন যেমন উপকূলের মানুষের; তেমনি প্রশ্ন আমারও। দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে অনেকের মনেই ছিল নানান প্রশ্ন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব পড়েছে উপকূলে। জেলে-বাওয়ালীদের জীবন হয়েছে অনেকটা নিরাপদ। এমন সময়ে এসে আবারও সুন্দরবনের ভেতরে ছোট ছোট দস্যু বাহিনীর আবির্ভাব নতুন করে শংকায় ফেলেছে বনজীবীদের জীবন। সুন্দরবনের খাল-নদীতে মাছ বা কাঁকড়া শিকারের জন্য যারা দিনের পর দিন অমানবিক পরিশ্রম করেন, লাভের ভাগ তাঁদের পকেটে আসে না বললেই চলে। পরিশ্রম আর ঝুঁকির পুরোটাই নিতে হয় এই জেলে-বাওয়ালীদের। এক শ্রেণির মহাজন বা সাহেব নামধারী ব্যবসায়ীরাই লাভের মূলটা খেয়ে ফেলেন। তাদেরই কেউ কেউ আবার দস্যুদের হাত থেকে জেলেদের নিরাপত্তা দেয়ার নামে জেলেদের কাছে থেকে টাকা তোলেন। কোন কোন ব্যবসায়ী সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। এই শ্রেণির ব্যবসায়ীরা এখনও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদেরও একটা ভাল বাজার ছিল এই সুন্দরবন। মাঝে একটু বিরতি দিয়ে তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি দস্যুতায় নামা বনদস্যু-জলদস্যুদের হাতে নতুন অস্ত্র-গুলি দেখে তা অনুমান করাই যায়। তাহলে উপকূলের মানুষদের মনে যে প্রশ্নগুলো ঘুরছে, তা কী যথার্থ? সত্যি সত্যি কী সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে? আর দস্যুমুক্ত সুন্দরবন হলেই কী প্রান্তিক জেলে-বাওয়ালীদের ভাগ্য পাল্টাবে? জেলে-বাওয়ালীদের ভাগ্যের পরিবর্তন-ই এখানে প্রধান বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিৎ। আর সেজন্য দাদন আর সুদের চক্র থেকে তাদের উদ্ধার করতে হবে। চরম দারিদ্র্য আর বৈরী প্রকৃতির কারণে বিপর্যস্ত সুন্দরবন আর উপকূলের মানুষ। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করা এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই। এই জনগোষ্ঠী সুসংগঠিত নয়। আর সেই সুযোগটিই আবহমান কাল থেকে নিচ্ছে অসাধু, সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা। তাই মনে রাখতে হবে। কৃতিত্ব দেখাতে নয়, সমস্যার মূল থেকে বুঝে কাজ করতে হবে। আর দস্যুদের জন্য নয়, জেলে-বাওয়ালীদের কথা মাথায় রেখে সমস্যার সমাধানে যেতে হবে। সেজন্য আত্মসমর্পণ বা আভিযানিক কাজের পাশাপাশি দস্যুতার পেছনের শক্তিকেও নির্মূল করতে হবে। সেখানে তেমন একটা কাজ এখনও হচ্ছে বলে মনে করছে না উপকূলের মানুষ। মোট কথা, বনদস্যু-জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের চিন্তাটি এসেছিল সুন্দরবনঘেঁসা জনপদের মানুষের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ ভূমিকা রেখেছেন বলেই তা এক রকম সফলও হয়েছে। তবে বাকী কাজগুলোও করতে হবে সমস্যার মূলে গিয়ে। তা না হলে সেই প্রান্তিক জেলে-বাওয়ালীদের জীবন আবারও বিপন্ন হবে। সুযোগ নিবে দাদন বা সুদের ব্যবসায়ীরা। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের পুনর্বাসিত না করলে সুন্দরবন উপকূলে অরাজকতা তৈরী হবে। মামলা জট থেকে সাবেক দস্যুদের মুক্ত করতে না পারলে তারা আবারও বিপথে ফিরতে পারে। আর তার সুযোগ নেবে সেই অসাধু ব্যবসায়ীরা। ক‚ল-কিনারাহীন বনজীবীরা যে আলোর সন্ধান পেয়েছিল, তা আবারও ঢেকে যাবে ঘন অন্ধকারে।
এবার আসি মূল কথায়। সুন্দরবনের খাল নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ। যাদের বসবাস সুন্দরবন আর উপকূল ঘেঁসা জনপদে। এসব এলাকায় জীবনযাপন অসম্ভব কঠিন, অসহনীয়। যেখানে খাওয়ার পানিটুকুও নেই, সেই জনপদের মানুষের বিপন্নতা মাপতে আর কোন হিসাব করা লাগে না। এই অঞ্চলের মানুষ মূলত মাছ আর কাঁকড়া ধরেই সংসার চালায়। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন তারা। এই বিপন্নতা থেকে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে বের করে আনতে পারলে দেশের এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সত্যি সত্যি কিছু করা হবে।
এজন্য বনের ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে অতীতের মত ভবিষ্যতেই দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি থাকতে হবে তাদের। সঞ্চিত অর্থ না থাকায় তারা মাছ ধরতে গেলেই মহাজনদের ওপর নির্ভর করে। আর মহাজন দাদন এর মাধ্যমে জেলেদের আহরণ করা সম্পদের লাভের বড় অংশ নিজেই নিয়ে নেয়। আবার স্থানীয়ভাবে সুদের ব্যবসা করে এক শ্রেণির মানুষ। অস্বাভাবিক বেশী সুদেও জেলেরা তাদের কাছে থেকে টাকা নিতে বাধ্য হয়। এই দুই চক্র থেকে গরীব জেলে-বাওয়ালীদের বের করতে না পারলে শুধু জলদস্যু-বনদস্যু নিধন করেও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে করি না। কারণ, দস্যুদের একটা বড় অংশই নদী খালে মাছ শিকার করত। নানা মুখী বঞ্চনার শিকার হয়ে অনেকেই দস্যুতায় এসেছে। দেনায় ডুবে অনেক জেলেই হয়েছে বিপথগামী। তাই সুন্দরবন উপকূলে সার্বিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে সবার আগে। এজন্য সবার আগে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা যদি সরকার করে তবে প্রাথমিকভাবে দাদন ও সুদের মহাজনদের হাত থেকে রেহাই পাবে তারা। এরপর তাদের আহরিত মাছ-কাঁকড়া অবাধে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাস, বাঁকীটুকু এই জেলে-বাওয়ালীরাই গড়ে নেবে। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবনের দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। শহরের অস্ত্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কিছু মাছ ব্যবসায়ীর নাম শোনা যায় এই দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। দস্যুতা দমনে অনেক কাজ হলেও সেই পৃষ্ঠপোষকদের অনেকেই এখনও আগের মতই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের কাছেও তথ্য আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে সেই গড ফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে হলে অবশ্যই এই পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটিও মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন ও সাগরে যারা জীবিকার সন্ধানে যায়, তারা অসম্ভব পরিশ্রমী ও সাহসী। তাদের জন্য শুধু প্রয়োজন একটু সমর্থন। শুরুর দিকে একটু অর্থনৈতিক সমর্থন দিতে পারলে পিছিয়ে পড়া বিশাল এই জনগোষ্ঠী ঘুরে দাঁড়াবে। তারাও দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। কাজেই পুরো সুন্দরবন উপকূলকে ঘিরে সঠিক পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে সবার আগে এর কোলঘেঁসা জনপদের মানুষকে স্বাবলম্বী করতে হবে। তাহলেই মানুষ বাঁচবে, বাঁচবে সুন্দরবন।