Site icon suprovatsatkhira.com

তিনকালের গণমাধ্যম, একালে কেমন

সুভাষ চৌধুরী

ব্রিটিশ পর্ব, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ পর্ব। ইতিহাসের এই তিন কালেই বাধা পড়েছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি। আবার এই তিনকে সাথে নিয়েই আমাদের পথচলা। এই তিনকে নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ। এই তিনকে নিয়েই গঠিত আমাদের ভবিষ্যত। এই তিনের চূড়ান্ত পর্বে সংঘটিত হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যা সমৃদ্ধ করেছে বাঙালি জাতিকে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ অর্জন করেছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি লাল সবুজ পতাকা।
এই তিনকে বিশ্লেষণ করলে আমরা একটি বিষয় নিশ্চিত করে পাবো, তা হলো আমাদের অধিকারের সংগ্রাম। শাসন শোষণ নিপীড়ন স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যেমন নীলকর বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছে, তাদেরকে যেমন কুইট ইন্ডিয়া বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তেমনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার দৃপ্ত উচ্চারণ হয়েছে। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি বুকের রক্ত দিয়েছে। পুষ্পিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বাঙালি। একইভাবে ১৯৭১ এ জাতি হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। তারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিতাড়ন করেছে পাকিস্তানি হানাদারদের। বাংলাদেশ পর্বে এসে নানা ঘটনাবলীর মুখোমুখি আমরা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছেই। কাজেই এই তিন কালের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। বারবার নানাভাবে শাণিত হয়েছে এ সংগ্রাম।
এই তিনকালের সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করলে গণমানুষের কথাই উঠে আসে। উপমহাদেশে জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত প্রথম যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল- ব্রিটিশ কালাকানুনের কাছে তাকে মাথা নিচু করতে হয়েছিল। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ অর ‘দ্য ক্যালকাটা অ্যাডভার্টাইজার’ ছিল সেই সংবাদপত্র। সেখান থেকেই শুরু পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার প্রয়াস। সমসাময়িক পত্রিকার মধ্যে ছিল ‘অমৃতবাজারপত্রিকা’। বাংলা ভাষায় শিশির কুমার ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাটির কণ্ঠরোধ করতে ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ভার্নাকুলার অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে। ১৮১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ‘দিগদর্শন’। জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত এই পত্রিকাটি ২৬টি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রংপুরের জমিদারের হাত ধরে ১৮৪৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘রঙ্গপুরবার্ত্তাবহ’ প্রকাশের পর দশ বছর টিকে ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসে ‘বেঙ্গল টাইমস’ ১৯০০ সালে। ইসি কেম্প ছিলেন এর সম্পাদক। এর আগে সেটি ছিল ‘দ্য ঢাকা নিউজ’। এর আগে ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। এর দ্বিতীয় সম্পাদক ছিলেন দীননাথ সেন। তারও আগে ১৮৬৩ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালি থেকে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশের পরই রোষানলে পড়েছিল। তবু কাঙ্গাল হরিনাথ ব্রিটিশ রক্তচক্ষুকে ভয় না করে সব বাধা বিপত্তিকে টপকে তার পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রেখে ব্রিটিশ বেনিয়াদের পর্যুদস্ত করে ফেলেছিলেন। এর পর থেকে বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকা মীর মোশাররফ হোসেনের ‘আজিজন নেহার’ ও ‘হিতকরী’, আবদুর রহিমের সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ ও মাসিক ‘হাফেজ’ সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলেছে। এসব পত্রিকা ছিল জনমানুষের মুখপাত্র। তাদের দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সরব উচ্চারণ। বাঙালি সমাজের মানুষের অধিকারকে শাণিত করা। ব্রিটিশ আমলের এই পত্রিকাগুলো ব্রিটিশ সরকারের চরম সমালোচক ছিল। পত্রিকাগুলো ছিল নির্ভীক। তাদের লেখায় সামাজিক আন্দোলন বেগবান হয়েছিল। শাসক এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্ট দূরত্ব ছিল। এই পত্রিকাগুলোর কলেবর বেশী ছিল না বটে। তাদের প্রকাশকালও বেশিদিন প্রলম্বিত হতে পারেনি। আধুনিক প্রযুক্তি দূরে থাকুক, পত্রিকাগুলো কখনও কখনও হাতে লিখেও প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক ছাপাখানায় তা মুদ্রিত হতো। অনেক সময় ব্রিটিশ শাসকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপন স্থান থেকে কাগজ প্রকাশ করা হতো। এক কথায় সেদিনের সংবাদপত্র ছিল বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর মুখপাত্র। পত্রিকাগুলো ছিল তাদের সাহসের পথের সঙ্গী।
সংবাদপত্রের দ্বিতীয় পর্ব পাকিস্তান শাসনামলের। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অপসারণের পর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মুখে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ। জন্ম লাভ করে দুটি রাষ্ট্র- ভারত ও পাকিস্তান। এ সময় ইতিহাসের নতুন বাক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময়ের মধ্যে ভাষার জন্য বাঙালি জাতির মধ্যে যেমন তীব্র জাগরণ সৃষ্টি হয়, তেমনি বাঙালির স্বাধিকার এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখনকার সংবাদপত্রগুলো বজ্র কঠিন ভাষা উচ্চারণ করতো। একে একে জন্মলাভ করে দৈনিক আজাদ, ১৯৫৩ সালে প্রতি সংখ্যা ছয় পয়সা মূল্যের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক মর্নিং নিউজ। কালজয়ী এসব পত্রিকা সফলতার সাথে সম্পাদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমেদুল কবির, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আব্দুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখ কালজয়ী সম্পাদক। এ আমলের সংবাদপত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল পাকিস্তানি শাসন শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রাম। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্বতা বজায় রাখা ও বাঙালি জাতির স্বাধিকার নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এর বিপরীতে ছিল জেল জুলুম এবং সামরিক শাসনের নিষ্পেষণ। এ আমলের সংবাদপত্রগুলো নিজেদের জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে পাকিস্তানিদের দুর্বৃত্তায়ন এবং শাসন শোষণের সব আচরণের বিরুদ্ধে। মানুষ এ সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। তাদেরকে বিতাড়নের চেষ্টায় সংগঠিত হয়েছে। রক্ত দিয়েছে বারবার। প্রয়াত এসব সম্পাদক জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। তাদের পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছাপাখানা সিল করে দেওয়া হয়েছে। বড় মাপের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করার ঘটনাও ছিল অনেক। ৬০ এর দশক থেকে আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন, ছয় দফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, গ্রেফতার- এসব কিছুই বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে শাণিত করে তুলেছিল। সমসাময়িক পত্রিকাগুলোও এই জন স্রোতে নিজেদের একাকার করে নিয়েছিল। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের নিত্য সাথী ছিল তখনকার সংবাদপত্র। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যাওয়া পাকিস্তানিরা ৭০ এ সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়নি। বাঙালির প্রতি এই অবহেলা, তার প্রতি শাসক সুলভ আচরণ এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই বাঙালিই রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ৭১ এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর নবায়ন ঘটে। ৭১ থেকে ২০১৮ এই সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বহু সংবাদপত্র নতুন করে জন্মলাভ করেছে। এখন এই সংবাদপত্রগুলোই বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। একজন বিদেশী রাজনীতিকের ভাষায় বলতে হয়, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যতটুকু কার্যকর হওয়ার কথা ছিল তা হতে না পারলেও এদেশের সংবাদপত্র সেই অভাব বহুলাংশে পূরণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে শাণিত করেছে।
তিন আমলের সংবাদপত্রের অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রামের সাথে সাথে বর্তমান সময়ের মানুষের সচেতনতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে তার প্রভাব পড়েছে। পাকিস্তান শাসনামলের শেষ দিকে টেলিভিশন বাজারে এলেও তা ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত। দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশনে এখন বাজার ছেয়ে গেছে। বর্তমান সময়কালে প্রকাশিত সংবাদপত্রের মধ্যে রয়েছে দৈনিক বাংলা (অধুনালুপ্ত), বাংলাদেশ অবজারভার (অধুনালুপ্ত), বাংলাদেশ টাইমস (অধুনালুপ্ত), দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক জনকন্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক সমকাল, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক মানবজমিন, ডেইলি স্টার, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট। এর সাথে সাথে বাজারে রয়েছে ইত্তেফাক, সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকা। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছে। এসব পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান, প্রয়াত ওবায়দুল হক, প্রয়াত এবিএম মুসা, প্রয়াত আহমেদ হুমায়ূন, তোয়াব খান, গোলাম সরোয়ার, আবেদ খান, মাহফুজ আনাম, প্রয়াত বজলুর রহমান, মতিউর রহমান, মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখ সফল সম্পাদক। পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছানো বর্তমান সময়কালের পত্রিকাগুলোর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে ৩০টিরও বেশি টিভি সংবাদ স্টেশন ও অগণিত অনলাইন পত্রিকা। এক রকম ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন পত্রিকাগুলো কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারেনি নিজেদের। ভুল বাক্য ভুল বানান ভুল তথ্যে ভরে রেখে সংবাদপত্রের রুচি নষ্ট করে দিতে শুরু করেছে। জবাবদিহিতাহীন বহু অনলাইন পোর্টালের বিকৃত সংবাদ, রুচিহীন সংবাদ, অশ্লীল ভাষার সংবাদ সমাজকে ভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর সাথে ফেসবুকের বৈকল্য, উচ্চারণ, মন্তব্য, ঘরগড়া শব্দ, ঘরগড়া বানান, ঘরগড়া বাক্য ও স্বেচ্ছাপাণ্ডিত্য মানুষের স্বাভাবিক জীবনে অস্থিরতা ও তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। মানুষ যে প্রিন্ট মিডিয়া পড়তে খুব ভালবাসে এ কথা সহজেই বুঝা যায়। কিন্তু তার এই প্রত্যাশাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে অনলাইন পত্রিকার অসহনীয় জট। পর্যাপ্ত লেখাপড়া না শিখে এমনকি কলম ধরে সংবাদ লিখবার এতোটুকু যোগ্যতা অর্জন না করেও অনলাইন এবং বেশ কিছু ভুঁইফোঁড় পত্রিকার সম্পাদকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন এই সমাজের কিছু উচ্চাভিলাসী মানুষ। অপর দিকে দেশের টিভি স্টেশনগুলো লাইভ রিপোর্টের পাশাপাশি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করে এক একটি ঘটনাকে সবার আগে তুলে ধরে পাঠক সমাজে সাড়া দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রিন্ট মিডিয়া নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করছে। কারণ প্রিন্ট মিডিয়ার প্রকাশ সময় দিনের শুরুতে। অপরদিকে অনলাইন ও টিভি নিউজের প্রকাশ ও প্রচারের সময়ের কোনো সীমারেখা নেই। সময়ের সাথে সাথে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার কমলেও গুরুত্ব ও প্রভাব কমেনি এক চুলও।
আমি বলবো ব্রিটিশ পর্ব এমনকি পাকিস্তান পর্বে সংবাদপত্র প্রকাশের লক্ষ্য ছিল “মানুষের পক্ষে কথা বলা। শাসকদের সমালোচনা করা। সামাজিক রাজনৈতিক ও আইনি অধিকার আদায় করা”। কিন্তু আজকের দিনের সংবাদপত্র প্রকাশের পেছনে রয়েছে কালোটাকা সাদা করা, দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া, রাজনৈতিক দল, উচ্চাভিলাস ও প্রত্যাশাকে শাণিত করা। ফলে এখনকার গণমাধ্যমগুলোর সংকট ভিন্নতর। এসব গণমাধ্যমে এখন শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। সংবাদকর্মীদের বেতনহীনতা, তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা, মালিক সম্পাদকের ইচ্ছা পূরণ করা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে সমালোচনা করে আড়ালে সুবিধা আদায় করা। পাশাপাশি এ দিনের গণমাধ্যমগুলোর বহুমুখিতা, সবার কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করা, সমাজ উন্নয়নে নানাবিধ কাজ করা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সমালোচনা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এখন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু লিখন দক্ষতা বাড়েনি। সাংবাদিকদের মর্যাদা বাড়ছে না, বরং ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে তাদের কথা বলার সাহস বেড়েছে কারণ বাজারে রয়েছে প্রতিযোগিতা।
বাংলাদেশের বর্তমান সময়কালের সংবাদপত্র ভুগছে তার অস্তিত্ব সংকট নিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়ে পড়েছে বিজ্ঞাপন নির্ভর। পাঠক নির্ভর সংবাদ মাধ্যম হারিয়ে যাচ্ছে। সংবাদকর্মীদের মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ জোরালো হওয়ায় তারা বিভক্তির শিকার হয়েছেন। তারা ব্যবহৃত হচ্ছেন কোনো না কোনো পক্ষ দ্বারা। তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা কেবল প্রত্যাশা হিসাবেই থেকে যাচ্ছে। একই সাথে সংবাদকর্মীদের বেতন চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে সমঝোতা করতে পারছে না মালিক সম্পাদকরা। ফলে তাদেরকে যথেষ্ট বেতন না দিয়ে কাজ করানোর সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে। এর আড়ালে ওই সংবাদকর্মী নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় অসাধু পথে হাঁটছেন। এতে সংবাদের মানও কমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির ৫৭ ধারা সংযুক্ত হয়েছে। এর অপপ্রয়োগও হচ্ছে বেশ। এই কানুনের টার্গেট হয়ে বাংলাদেশের অনেক সংবাদকর্মী জেল খেটেছেন। এর সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তার নতুন ধারা চালু হওয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রবণতা প্রায় থমকে গেছে। তবে প্রিন্ট মিডিয়াগুলো এখনো শক্তিমানের শীর্ষে আছে।
এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি। জাতীয় দৈনিক কাগজগুলো প্রকাশিত হচ্ছে ২০ থেকে ২৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। দাম ১০ টাকা। এই হিসাবে বলতেই হবে ‘সবচেয়ে সস্তা পণ্য সংবাদপত্র’। পাঠক কমে যাওয়ায় কমেছে প্রচার ও প্রকাশ সংখ্যা। টান পড়েছে অর্থনীতিতে। কাগজটি তাই টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। ব্রিটিশ পর্বের সংবাদপত্রগুলো সরকারের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান পর্বে তারা যুদ্ধ করেছে কালাকানুুন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। আর বর্তমান সময়ে সংবাদ মাধ্যমে চলছে গৃহযুদ্ধ। তা কখনও মালিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে, কখনও রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে আবার কখনও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে। এছাড়া মুহূর্তে মুহূর্তে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে প্রিন্ট মিডিয়ার সাথে টেভি স্টেশন ও অনলাইন পত্রিকার। অঘোষিত যুদ্ধ চলছে তথ্য প্রযুক্তির ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল আইনের ৩২ এর বিরুদ্ধে। এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন রক্ষায় সংগ্রাম হচ্ছে না জোরদারভাবে। তবে, সংবাদকর্মীরা উচ্চকিত করছেন মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার সংগ্রাম, জাতীয় সংগ্রাম, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম। এদিনের সংবাদ মাধ্যমে সরকারের সেন্সর থাকছে না। সংবাদ মাধ্যমগুলো বহুলাংশে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারছে। ক্ষেত্র বিশেষে সরকারও কোনো কোনো সংবাদের প্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার সব গণমাধ্যম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আকাশচুম্বী সাফল্য ভোগ করছে। নিউজ প্রিন্ট সংকট ও তার মূল্য বৃদ্ধি প্রিন্ট মিডিয়াকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
সব মিলিয়ে বলতে হবে বাংলাদেশের একালের সংবাদপত্র বহুমুখিতা অর্জন করেছে। একই সাথে এসব গণমাধ্যম প্রতিযোগিতার দৌড়ে হাঁফিয়ে উঠছে। কারণ বিজ্ঞান প্রযুক্তি যেমন দিয়েছে তেমনি কেড়েও নিয়েছে অনেক কিছু। তাই টিকে থাকার সংগ্রামই এখনকার সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: ডিস্ট্রিক্ট করেসপনডেন্ট, এনটিভি ও দৈনিক যুগান্তর, সাতক্ষীরা।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version