ডেস্ক রিপোর্ট: বিচারালয়ে আবেগের কোনো মূল্য নেই। আইন বলে ‘সাক্ষী লাগবে’। আবার সন্দেহ কোনো দ-ের ভিত্তি হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন সাতক্ষীরার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার। তিনি বলেন, আমাদের দেশে আইন জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। এসব কারণে মানুষ ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়।
জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার বুধবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শহীদ স ম আলাউদ্দিন মিলনায়তনে আয়োজিত এক মত বিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করছিলেন।
দেশের ৯৮ শতাংশ আইন আসামির পক্ষে উল্লেখ করে তিনি বলেন মাদক, হত্যা, ধর্ষণ- যে অপরাধের কথাই বলা হোক সেখানে যথেষ্ট প্রমাণ লাগবে। মাত্র দুই শতাংশ আইন প্রসিকিউশনের পক্ষে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ক্রিমিন্যাল মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এসব কারণে অনেক মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে স্বচ্ছ হওয়া দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মত বিনিময় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন সাতক্ষীরা আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এসএম হায়দার। এ সময় প্রধান অতিথি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
তিনি বলেন, এভিডেন্স বা প্রমাণ আইনের ক্ষেত্রে অনেক বড় অনুসঙ্গ। এর তিনটি ভাগ প্রত্যক্ষ, দালিলিক ও অবস্থাগত বা পরিস্থিতিগত। কানে শ্রুত এভিডেন্স কোনো এভিডেন্স নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ ধরনের এভিডেন্স হাজির করলে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা পেয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে বিচারালয়ের প্রতি অবিশ্বাস এমনকি অনাস্থা এসে যায়। সংবাদকর্মীদেরও আইন জানা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, এতে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পাবে। আইন জানা থাকলে আাইনজীবী সাংবাদিক এমনকি বিচার প্রার্থীদেরও পাওয়ার বৃদ্ধি পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি হত্যার পর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট ও সুরতহাল রিপোর্টের মধ্যে গরমিলের কথা উল্লেখ করেন। এ ধরনের বৈষম্য দেখা দিলে আদালতের ওপরকার কনফিডেন্সের ক্ষতি করে। সংবাদ কর্মীদের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সতর্ক করতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন একটি অপরাধের সাথে জড়িত দুই জনের একজন অপরাধ স্বীকার করলে এবং অপরজন স্বীকার না করলে দ-ে তারতম্য হতে পারে। বর্তমানে বিস্ফোরক মামলা বেশি হচ্ছে উল্লেখ করে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বলেন, এক্ষেত্রে রাসায়নিক পরীক্ষা খুবই জরুরি। রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া চার্জশিট দিলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, প্রতি একশত মামলার ৯৯টিতে রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণ ঘটনার পর পরিবারের লোকজন সেই নারীকে দ্রুত গোসল করিয়ে পরিপাটি করে তোলেন। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল সার্টিফিকেটের সাথে দরকার ধর্ষিতার কাপড়চোপড়ের কেমিক্যাল রিপোর্ট। অনেক সময় তা নেই দেখিয়ে দেওয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারে। আবার দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা হলে ছয় মাস পর্যন্ত কাপড় চোপড়ে আলামত মিলানো যায় বলে প্রমাণ করে থাকেন। এমনটি হলে ভিকটিম ন্যায় বিচার লাভ করতে পারেন। কাপড় চোপড়ের কেমিক্যাল রিপোর্ট তৈরি না করায় অনেক গণধর্ষণের ক্ষেত্রেও আসানিদের সাজা হয় না বলে উল্লেখ করেন তিনি। নো সাইন অব রেপ স্পষ্ট হওয়ায় বিচারপ্রার্থী যেমন বঞ্চিত হন তেমনি এর দোষ চাপে বিচারকের ওপর।
আমাদের মধ্যে পেশাগত ঈর্ষা না থাকাই বাঞ্ছনীয় উল্লেখ করে জেলা ও দায়রা জজ বলেন, সাতক্ষীরার একটি প্রাচীর কালেক্টরেট ও আদালতের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, এখানে একটি ছোট্ট পকেট গেট করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
আমাদের দেশে আইন শুধু কিতাবে আছে উল্লেখ করে আমরা একটি ভাল অবস্থার প্রত্যাশায় আছি জানিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আরও বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বেশি পড়াশুনা করে থাকেন। প্রসিকিউশন এমনকি জিপিরাও পড়াশুনা বেশি করেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের দক্ষতার মাপকাঠির ওপর বিচার নির্ভর করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে তিনি বলেন, সচরাচর পুলিশ আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে তার অপরাধের কথা বলে। তিনি বলেন, আইন হলো ঘটনাস্থলে ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত থাকতে হয়। তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তার স্বাক্ষর নেয় পুলিশ। আইনে এটা গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধ সংঘটনের সময় কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যাবেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটেনে একজন নারী ধর্ষণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কেউ মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ক্রস ফায়ারকে তিনি ‘ক্রস ফায়ার’ না বলে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে মন্তব্য করেন। সহকারি কমিশনাররা সবাই সব সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর পোশাক পরতে পারেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জেলা ও দায়রা জজ বলেন, আমরা আইনের বিচার করি, ন্যায় বিচার করি না। অথচ ন্যায় বিচারের শপথ করেই আমরা কখনও কখনও মিথ্যা কথা বলি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শেষ হলেই কেবল আসামি তার বক্তব্য দিতে পারেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সময় তিনি দোষী না নির্দোষ তা বলতে পারেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি সরকারের দেওয়া আইন সহায়তা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। একই সাথে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, গ্রাম আদালত একটি চমৎকার বিচার ব্যবস্থাপনা। একে আরও বেগবান করা গেলে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর চাপ কমবে। তাছাড়া মানুষও স্বল্প খরচে কম সময়ে ন্যায় বিচার পেতে পারবেন। বিভাগীয় পর্যায়ে সাইবার কোর্ট স্থাপনে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, হত্যা মামলা ও ধর্ষণ ঘটনায় সাক্ষীর খুবই দরকার। তিনি সকলকে আইন সম্পর্কে সচেতন হবার আহবান জানিয়ে আরও বলেন আইন মানুষের চক্ষু খুলে দেয়। এতে ন্যায় বিচার পাওয়াও সহজ হয়।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারীর সঞ্চালনায় মত বিনিময় সভায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশ্ন রাখেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সুভাষ চৌধুরী, সাবেক সভাপতি আনিসুর রহিম, প্রথম আলোর কল্যাণ ব্যানার্জি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমেদ বাপী, ভোরের কাগজের ড. দিলীপ কুমার দেব, প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার, আরটিভির রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, একাত্তর টেলিভিশনের বরুন ব্যনার্জি প্রমুখ। জেলা ও দায়রা জজ তাদের প্রশ্নের জবাব দেন।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার দেশের ৯৮ শতাংশ আইন আসামির পক্ষে
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/