Site icon suprovatsatkhira.com

সমকালীন ভাবনা বন্ধু কি খবর বল?

সন্দীপ দাস

একটাই কথা আছে বাংলাতে, বুক আর মুখ বলে একসাথে; সে হল বন্ধু……… বন্ধু আমার। রক্তের সম্পর্কের বাইরে আত্মার সম্পর্ক যার সাথে গড়ে ওঠে সেই তো বন্ধু, সেই তো সুহৃদ। হৃদয়ের সুবৃত্তি যাকে বেধে রাখে- সেই তো আমার সুহৃদ। মানব ইতিহাসের সুপ্রাচীন গ্রন্থ, গল্প-গান-কবিতা সর্বত্রই বন্ধুত্বের অমর কাহিনী, কখনও আবার বিয়োগান্তক রক্তক্ষরণ সবই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। তাইতো যুগে যুগে আমরা টেনে আনি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ অথবা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের চরিত্র ‘বদি’ ভাইকে। এসব উপন্যাস কিংবা নাটকের চরিত্রগুলো শুধুই সাদা কাগজে কালো কালির রঙের আচড়ে ফুটিয়ে তোলা চরিত্র নয়, এতো সমাজের প্রতিচ্ছবি।
আজকের সমাজ বড্ড ক্ষয়িষ্ণু। জীবন আর জীবিকার তাগিদ আর বিশ^ায়ন ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন আমাদের চিরচেনা সমাজটাকে যেন আমূল পাল্টে দিচ্ছে প্রতিটা দিন। ছেলেবেলায় স্কুল মাঠে বর্ষার দিনে ফুটবল, ধানকাটা শেষে জ্যৈষ্ঠের বিকেলে ঘুড়ি উড়ানো, দলবেধে সাঁতার অথবা ঝড়ের শেষে আমের সন্ধানে ছুটোছুটি- সবই ছিল আমার সবুজ বাংলায়। বন্ধুপাগল বন্ধুপ্রাণ সেইসব দুরন্ত ছেলেবেলা আজ যেন স্মৃতি জাগানিয়া অতীত।
গতিশীল সমাজ ব্যবস্থা আজ যেন দুরন্ত পাগলা ঘোড়া। আর সেই গতিকে আরোও দুর্বার করে দিচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট। দলবেধে আজ আর পাড়া মহল্লার বন্ধুরা তাস, দাবা, পাশা, ক্যারাম, লুডু খেলে না। ওরা ইন্টারনেটে ডাটা কানেকশন অন করে গ্রæপ চ্যাট, ভিডিও শেয়ারিং, বøু-হোয়েল, টিউবমেটে ডাউনলোডিং-এ সময় পার করছে। বন্ধুত্বের সেই পুরাতন সঙ্গ আজ ‘ফেসবুক’ নামক নতুন যান্ত্রিক ওয়ালে আটকে গেছে। ফেসবুকের ওয়াল পুরান দিনের বন্ধুত্বের প্রাণবন্ত আড্ডা কিংবা আয়োজনে বাস্তবেই যেন ওয়াল (দেয়াল) তুলে দিয়েছে। তারপরও অবাক হয়ে দেখি এ প্রজন্ম এই আধুনিকতায় যেন বেশ মজেছে। ওরা জীবন্ত/সরাসরি বন্ধু না পেয়ে আনলিমিটেড/অন-লাইন বন্ধু নিয়েই সন্তোষ প্রকাশ করছে।
আচ্ছা একটা মানুষের কতগুলো বন্ধু থাকতে পারে? বড় জোর ৫-১০ জন (যদি অবশ্যই বন্ধুর মত বন্ধু হয়!) অথচ ফেসবুক দুনিয়ায় বন্ধু সংখ্যা আজ প্রেজটিজ (ঢ়ৎবংঃরমব) ইস্যু। হাজার দশেক বন্ধু, হাজার তিনেক লাইক ছাড়া কলেজ পড়–য়া, চাকুরিজীবী এমনকি মুদি দোকানিটাও কেমন যেন একঘরে। আমি কখন ই বলছি না চলো আমরা পুরানো দিনে ফিরে যাই। টাইম মেশিনে চড়ে পিছনে ফিরে যাওয়ার উপায় তো নেই। মানুষই তো বারবার সভ্যতার বিকাশ আর উন্নয়ন চেয়ে আন্দোলন করেছে। তাই মিছে মায়াকান্না করাটা বৃথা নয় বরং বোকামি।
আমি হাজার হাত পা ছোড়াছুড়ি করলেও পুরানো সেই খেলার মাঠ, মস্ত বড় পুকুর, পাল তোলা নৌকা, বয়ে চলা নদী- কোনকিছুই হয়তো ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই বলে বন্ধুত্ব শব্দটারও এমন রূপ পরিবর্তন হবে। বন্ধুত্ব আটকে যাবে ৮-১০ ইঞ্চি পর্দায়, বুড়ো আঙুলের ছোয়ায় পাঠানো ইমোকটিনে। বন্ধুর হাসি-কান্না, রাগ-ক্ষোভ ফুটে উঠবে! এ যেন অসহায় আত্মসমর্পণ।
হাল ফ্যাশনের যুবরা একবিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগই যেন পরিবারে থেকেও পরিবারহীন। বাবা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, মা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা অথবা কর্মজীবী বাবা-মা- এমন সংসারে এক সন্তান হয়ে বেড়ে উঠছে আজকের শিশুরা। পারিবারিক ¯েœহ, আত্মীয়ের বাড়ি দাওয়াত, মামার দেশে আম কুড়ানো তাই আর কিছুই জোটে না। বুয়ার হাতের রান্না, প্রাইভেট টিউটরের হোম টাস্ক, স্কুল ভ্যানের অপেক্ষা, সকাল বিকাল ক্লাস, আর ঘরে ফিরে ক্যাবল লাইনে সিরিয়াল দেখা- এই যেন নৈমিত্তিক জীবনযাপন। তাই আপন মনে এ যুব-শিশু গান গায় না, কবিতার পংক্তি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে না। ওর না জোটে বন্ধু না জোটে আসর। জীবনের শুরুতেই জোটে বন্দীত্ব।
এই বন্দিদশা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে মুঠোফোন আর ইন্টারনেট প্যাকেজ। তারবিহীন যোগাযোগে অল্প খরচে হু হু করে প্রতিদিন বন্ধু বাড়ছে, কিন্তু মনের বীণার তারে কজন’ই বা সুর তোলে? মজার ব্যাপার হচ্ছে বন্ধুত্ব হয়ত বয়স দিয়ে পরিমাপ করা যায় না অথবা বয়সের মাপকাঠিতে বন্ধুত্ব গড়েও ওঠে না। শুধুমাত্র এই একটি জায়গায় ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব তার সুনাম অক্ষুণœ রেখেছে। তবে যে বিষয়টি বেশি পীড়া দেয় তা হল ভার্চুয়াল বন্ধুত্বে যেহেতু সরাসরি যোগাযোগ, মুখোমুখি সাক্ষাৎ কমই সংগঠিত হয় তাই বন্ধুত্ব অনেকটা প্লাস্টিক বন্ধুত্বে পরিণত হয়। (যদিও ভিডিও কলের মাধ্যমে মুখ দেখাদেখির কাজটা ভালই চলছে)।
আজকের অবতারণা যে বিষয়ে সেখানে বন্ধুগুলোর নিষ্প্রাণতা, নির্জীবতা (যদিও এ সময়ের বন্ধুরা অনেক রাত অবধি সজাগ থাকে আর দিনের বেশিরভাগ সময়ই থাকে ঝিমুনিতে) বেশিই চোখে পড়ে। বন্ধুত্ব যেখানে সজীবতা আনবে, দেহে আনবে সতেজতা, প্রাণে আনবে উন্মাদনা, মনে আনবে বাহারি আমেজ অথচ সমাজে আজ তার বিপরীত চিত্রটাই চোখে পড়ছে। ফেসবুকের দেয়ালে বন্ধুত্ব আমাদের এমন অদৃশ্য দেওয়ালের ঘেরাটোপে বন্দি রেখেছে যে, আমরা দিনদিন গৃহবন্দির মত হয়ে পড়ছি। বন্ধু যেখানে পরম আশ্রয় সেইখানে নতুনমুখগুলো নতুন আধুনিকতায় বড় বেশি হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। যুব সমাজে তাই প্রকোপ বাড়ছে মাদকের।
বন্ধুমহলের আড্ডায় সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, থিয়েটার আজ প্রায় অনুপস্থিত। সমাজের দর্পণে যে বন্ধুরা সভা সমিতি করবে তারা আজ অনুপস্থিত। এমন একটা মরুতে বাগিচা গড়ে তুলতে দৃপ্ত শপথ নিয়ে এগিয়ে এসেছে ‘সুপ্রভাত সাতক্ষীরা’। প্রচÐ আত্মবিশ^াসী কিছু যুবারা সমাজকে বদলে দিতে যেন বদ্ধপরিকর। আর সেই প্রতিজ্ঞাকে বান্তবায়ন করতে দরকার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি, খেলার মাঠে রোজ বিকালের ছুটোছুটি, মরিচ্চাপ নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা রাস্তায় দলবেধে হাটাহাটি, সাতক্ষীরা মেডিকের কলেজের গা বেয়ে চলা ‘লাভ রোডে’ বন্ধুর গীটারের টুংটাং, রোজায় সমাবেত ইফতারি, তারাবি নামাজে জোট বেধে হাজির হওয়া, রাজ্জাক পার্ক কিংবা পাঠাগারে সাহিত্য আড্ডা- যেন সব কাজে আবার আমরা এক হই, আবার আমরা জেগে উঠি। দূরে ঠেলে ফেলি নিঃসঙ্গতা, নৈরাশ্য আর মাদকাসক্ত বন্ধুকে।
পরিবর্তন অবশ্যম্ভবী। কিছু পরিবর্তনকে মেনে না নিয়ে কিছুই করার থাকে না। তবে সেগুলো তোলা থাক স্বাস্থ্য, নিন্দ্রা, পড়ালেখা, পরিশ্রম আর মেধা বিকাশে। বন্ধুত্বের সাথে যেন কোন আপোষ না করি। অ সধহ রং শহড়হি নু যরং ভৎরবহফং. এমন প্রবাদ বাক্যকে আমরা যেন চরিতার্থ করার জন্য কঠোর হই। একজন ভাল বন্ধু কতটা দরকারি সেকথা ভারতের রাষ্ট্রপতি (সাবেক) এপিজে আব্দুল কালাম বলেছেন তার বাণীর একটিতে। তাই এজন্য আমাদেরকে অতি দ্রæত ফিরতে হবে বন্ধুর সুলুক সন্ধানে। পরিবার, বাবা-মা অবশ্যই আমাদের আপন। একটা বয়সে তারা আশ্রয় আবার তারাই হয়ে ওঠে বন্ধু। কিন্তু তারপরও জীবনের তাগিদ আমাদেরকে থেমে থাকতে দেয় না। জীবন খুঁজে ফিরে নতুন মুখ। আমরা বেছে নেই নতুন সাথী। বন্ধু নির্বাচন যে বড়ই শক্ত কাজ। ক্লাসের শিক্ষক, অভিভাবক যত গুরুজনই হোক না কেন বন্ধু কিন্তু তারা নির্বাচন করে দিতে পারে না। এটা একান্তই আমাদের নিজেদের অন্তরের গহীনের গভীরের আকর্ষণ আর খোদর মেহেরবানি। তাই বন্ধুবিহনে জীবন হয় ধূসর আর বন্ধুর আগমনে জীবন হয় উদ্যমী। চলার পথে একলা চলো নীতি-যদিও স্বাবলম্বীতা তবুও বন্ধু যখন হাত বাড়ায় যে হাত ছেড়ো না। মনে রেখো ভাত ছেড়ো তবু সাথী ছেড়ো না।
সব বন্ধুর প্রতি রইল শুভেচ্ছা। লেখক: কথাসাহিত্যিক

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version