প্রফেসর আব্দুল হামিদ
অত্যাধুনিক ব্যান্ড-সংগীতের তাণ্ডবে একদা বহু জনপ্রিয় বাংলাগানের সলিল সমাধি ঘটলেও রবীন্দ্র-সংগীতের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান রয়ে গেছে। এ এক আশ্চর্য ঘটনা বটে। তবে এরও একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কারণটি হৃদয়ের আর্তি-সংক্রান্ত। গীতিকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ও সুরারোপিত অজস্র গানে কথা ও সুরের যুগলবন্দী ঘটিয়েছেন যা আধুনিক স্রোতার মনে এবং প্রাণে যুগপৎ আবেদন সৃষ্টি করে ও তাকে সম্মোহিত করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা আধুনিক এবং তাঁর গানের প্রারম্ভিক চরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রথম চরণেই তিনি শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তার গানের জনপ্রিয়তার এটা একটা গৌণ কারণ। কিন্তু প্রথম আকর্ষণ হিসেবে এরও একটা গুরুত্ব আছে। এমন অনেক প্রারম্ভিক চরণ আছে যাতে মূল ভাবটিকে সামনে আনা হয়েছে। যেমন-
(১) আমার পরাণ যাহা চায়/তুমি তাই, তুমি তাই গো।
(২) কাছে ছিলে, দূরে গেলে/দূর হতে এসো কাছে।
(৩) তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ/ওমোর ভালবাসার ধন।
(৪) আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল/সুধাইল না কেহ।
(৫) আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ/খেলে যায় রৌদ্র ছায়া বর্ষা আসে (আসে) বসন্ত।
(৬) বসে আছি হে, কবে শুনিব তোমার বাণী।
(৭) আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।
এমন অজ¯্র উদাহরণ দেয়া যাবে যে সব গানে মূল ভাবকে অল্প কথায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ চরণগুলো প্রবাদ বাক্যের মতো বাঙালি শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে। আবার অনেক প্রারম্ভিক চরণে প্যারাডক্স ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন –
১। অনেক কথাই যাও যে বলে কোন কথা না বলি/তোমার ভাষা বুঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
২। লুকালে বলে খুঁজে বাহির করা/ধরা যদি দিতে তবে যেতো না ধরা।
৩। তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর/মুক্তি আমার বন্ধন ডোর।
উপরে উদ্ধৃত চরণগুলোতে প্যারাডক্স বা আপাতঃবিরোধী সত্য ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেক কথাই বলা হল অথচ কোন কথাই বলা হল না, ধরা দিলে ধরা যেতো না বা তৃপ্তির ভিতরেই অতৃপ্তি বোধ করা এবং মুক্তিকে বন্ধনডোর মনে করাÑ এগুলোই প্যারাডক্স। আপাতঃবিরোধাত্মক হলেও এই উক্তিগুলো কবি রবীন্দ্রনাথের জন্য হৃদ্যিক উপলদ্ধিজাত পরম সত্য। সেই সত্যের তিনি অনুররণ ঘটিয়েছেন সুমিষ্ট গভীর সুরের দ্যোতনায়। কথা ও সুরের এমন হৃদয়হারক যুগলবন্দী বিশ্বের আর কোন গীতি কবির রচনায় ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। আমরা হয়তো কখনই তলিয়ে দেখি না যে রবীন্দ্রনাথ সনেট রচনায় বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। কেবলমাত্র চৈতালী কাব্যের গুটি কয়েক সনেট ছাড়া তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কবি জীবনে সম্ভবত আর কোন সনেট রচনা করেননি। কণিকা নাম দিয়ে পরবর্তীকালে তিনি তার এই অসম্পূর্ণতার কিছুটা পূরণ করেছিলেন বলে মনে হয়। সনেট প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করার কারণ এই যে, অজস্র গান রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সনেট রচনার অসম্পূর্ণ কাজটিই সম্পূর্ণ করেছেন। সনেটে একটি মাত্র ভাব বা আইডিয়াকে সুনির্দিষ্ট আর্টের ফ্রেমে ব্যক্ত করা হয়, সেটাকে বিস্তৃত বা ডেভালপ করা হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধিকাংশ গানে এই রীতি প্রয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন পাশ্চাত্য রীতি যথাÑ প্রস্তাবনা, প্রথমা, অন্তরা ও সঞ্চারি। প্রথমা ও সঞ্চারি অংশে সুর ও তাল একই আর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর অংশ অন্তরায়ে রয়েছে তাল ও সুরের স্থিরতা ও ভিন্নতা। তবে অনেক গান শুধু প্রস্তাবনা ও প্রথমা দিয়েই শেষ হয়েছে।
এ নিবন্ধনের বিষয়বস্তু রবীন্দ্র সংগীতে কথা ও সুরের যুগলবন্দী। তাই আঙ্গীকের বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কথা বলে মূল বিষয়ে ফিরে যাবো। আর সে প্রসঙ্গের সূচনাতেই বলা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুবিশাল কবি-সত্ত¡ার অধিকারী অর্থাৎ মহাকবি। কিন্তু মহাকাব্য রচনায় তিনি হাত দেননি, কারণ তিনি জানতেন ‘‘সে-যুগ হয়েছে বাসি।’’ সেই অরচিত মহাকাব্যের ব্যঞ্জনা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর রচিত বিপুল সংখ্যক গীতি-কবিতায়। এ প্রসঙ্গে তিনি তার রোম্যান্টিক সত্ত্বা বা মানস-সুন্দরীকে সম্বোধন করে ক্ষণিকা কাব্যে বলেছেন:
আমি নাব্বো মহাকাব্য সংরোচনে ছিল মনে
ঠেক্লো কখন তোমার কাঁকন- কিঙ্কিনীতে/কল্পনাটি গেল ফাটি হাজার গীতে।
‘হাজার গীতে’ অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক গীতি-কবিতায়। গান ও গীতি-কবিতার পার্থক্য খুবই সামান্য। গানে থাকে কথা ও সুরের সমবেত অবস্থান। গীতি-কবিতায়ও সুর সৃষ্টি করা হয় কথার মালা গেঁথে। তাতে থাকে ছন্দ, মিটার, ধ্রæবপদ ও শব্দ-ঝংকার, শব্দ-গাম্ভীর্য ইত্যাদি। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়েই মূল আলোচনায় ফিরে যাব। ‘ক্ষণিকা’ কাব্যের ‘নববর্ষা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন:
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে, হৃদয় নাচে রে।
শত বরণের ভাব-উচ্ছাস
কলাপের মতো করেছে বিকাশ
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে \
এই কাব্যাংশে রিফ্রেইন বা ধ্রæবপদের ব্যবহার এক রকম গীতি-মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে। তাছাড়াও রয়েছে অদম্য আবেগ-‘উল্লাসে কারে যাচে রে’’। অপূর্ব কাব্যিক বর্ণনাও রয়েছে এখানে। এ ছত্রগুলো যেন সুরের জন্য অপেক্ষা করছে। সামান্য দু’একটা শব্দ ছেড়ে দিয়ে সুর ছড়িয়ে দিলেই অপূর্ব একটি গান শোনা যাবে। তবে বর্ষণমূখর পরিবেশে যে অদম্য আবেগ কবিকে উদ্বেলিত করে তুলেছিলো তা প্রকাশ করার জন্য গানের কয়েকটি ছত্রই যথেষ্ট ছিল না। তাই সে আবেগ বিস্তৃত ও বিকশিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে বিখ্যাত একটি রবীন্দ্র গীতি কবিতায়। সুতরাং গীতি কবিতা এবং গানের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। রবীন্দ্র-সঙ্গীত বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য শিল্প। এই শিল্পের আছে একটি ক্রমবিকশিত ধারা। সেই ধারা অনুসরণ করেই রবীন্দ্র-সঙ্গীতে কথা ও সুরের যুগলবন্দী বিষয়ে এখন আলোচনা করবো। একথা রবীন্দ্র-বোদ্ধা সকলেরই জানা আছে যে, প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী শীর্ষক গীতি-কবিতার দ্বারা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এমনকি ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ নাম দিয়ে অনেক পদাবলীও রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন বাংলা গান ও কবিতা রচনা শুরু করেন তখন বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব রয়ে গেছে তাঁর কথা ও সুরে। তবে গানের আঙ্গীকে তিনি এনেছেন পাশ্চাত্য রীতি। যেমনÑ ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’Ñ গানটি। এ গানের পটভ‚মিতে আছে গভীর নীশিতে শ্রীরাধিকার প্রেমাভিসারের অভিজ্ঞতা। বাসর রজনীতে দয়িতের সাথে দৈহিক মিলনের পর প্রভাতের আলোয় লজ্জাবনত রমনী ঘরের বাইরে যেতে ভীষণভাবে কণ্ঠিত বোধ করছে। সেই নিরাভরণজনিত লজ্জা বিস্তৃত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে প্রকৃতিতে। ‘‘আলোক পরশে মরমে মরিয়া/হের গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া। কোন মতে আছে পরাণ ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে।’’ গানটির সুর ও আঙ্গীকে পাশ্চাত্য রীতির সার্থক প্রয়োগ লক্ষ্য করার মতো।
বৈষ্ণব পদাবলী ধারার একটি বিখ্যাত গান : ‘‘ওহে জীবনবল্লভ/ওহে সাধন দুর্লভ।’’ ¯্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের বাসনা ব্যক্ত হয়েছে গানটিতে। বৈষ্ণব কবিতা মানবাত্মারূপী শ্রীরাধিকার শ্রীকৃষ্ণরূপ পরমাত্মায় আত্মনিবেদনের আর্তিতে ভাস্বর। আমাদের আলোচ্য রবীন্দ্র-সংগীতটিতেও ¯্রষ্টার কাছে আত্মনিবেদনের আকুতি ব্যক্ত হয়েছে ঐ একই স্টাইলে। গানটিতে পদাবলীর সুর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যেমন- ‘‘দিনু চরণতলে/কথা যা ছিল দিনু চরণতলে/প্রাণের বোঝা বুঝে লও দিনু চরণতলে/শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহ সব/আমি কী আর কব……..। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন ছিল প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত বিরহ শোকে জর্জরিত। এই বিয়োগ যন্ত্রণা তিনি সহ্য করে গেছেন অসীম ধৈর্যের সাথে। নিজের দুঃখ বেদনার কথা তিনি কখনও প্রকাশ করতেন না। অন্তর্বেদনা গোপন করার বাসনাও ব্যক্ত হয়েছে আমাদের আলোচ্য এই গানটিতে:
নীরবে যাব/পথের কাঁটা মানবো না আমি নীরবে যাব/হৃদয় ব্যথায় কাঁদবো না নীরবে যাব/শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহসব/আমি কী আর কব..।
¯্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনের আরেকটি বিখ্যাত গান:
‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা, প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে/যায় যেন মোর সকল গভীর আশা, প্রভু তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।’
ইতালি দেশীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ফাদার দ্য তিয়েন এই গানটির ভক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এই গান গাইতে গাইতে যেন তাকে কবরে নিয়ে যাওয়া হয়, এমন বাসনাও তিনি ব্যক্ত করেছিলেন (উৎস: দেশ পত্রিকা, ২ অক্টোবর, ২০০৩/৭০ বর্ষ ২৩ সংখ্যা) সম্প্রতি তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। জানিনে, তার জানাজায় এ গানটি গাওয়া হয়েছিল কিনা। উল্লেখ্য, ফাদার দ্য তিয়েন বাংলায় লিখতেন এবং সুদূর ইতালি থেকে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রবন্ধ পাঠাতেন।
এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় কেবলমাত্র গানে। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে/আমার সুরগুলি পায় চরণ/আমি পাইনে তোমারে। রবীন্দ্রনাথের গভীরতম অনুভ‚তি প্রকৃতপক্ষে গানের কথা ও সুরে ব্যক্ত হয়েছে। কেবলমাত্র কথাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেই তিনি নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। কথা ও সুরের যুগলবন্দী শোনার সৌভাগ্য বিশ্ববাসীর হয়নি। আর তা যদি সম্ভব হতো তাহলে রবীন্দ্র সংগীতে অনেক আগেই নোবেল পুরস্কার স্বতন্ত্রভাবে দেয়ার ব্যবস্থা হত। অতি সম্প্রতি বব ডিলান-এর গানকে সাহিত্য বিবেচনা করে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বস্তুত এ বিবেচনায় অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথকে ঐ পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হয়েছে কারণ ইংরেজি গীতাঞ্জলি বা সংঅফারিংস-এর অধিকাংশই সুর বিহীন গান অর্থাৎ গানের কথামালা।
রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুদূরের পিয়াসি। এক গানেই তিনি বলেছেন:
‘‘আমি চঞ্চল হে/আমি সদূরের পিয়াসি/ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর/তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী/মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাই/সে কথা যে যাই পাশরি।’’ আরও এক গানে বলেছেন: ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে/আমার মন যেতে চায় অচিন পুরে।’ কবির এই রোমান্টিক প্রবণতাই তাঁকে মরমিবাদের দিকে নিয়ে গেছে। দার্শনিকতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ চধহঃযবরংঃ বা সর্বেশ্বরবাদী। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের মতোই তিনি সৃষ্টির ভিতরে ¯্রষ্টার অস্তিত্ব উপলদ্ধি করেছেন। কবি প্রকৃতির বুকে তার অবস্থান যেন দূর থেকে বংশীধ্বনির মতো শুনতে পাচ্ছেন: ‘‘কোন অনেক দূরে উদাস সুরে/আভাস যে কার পাইরে/আছে আছে নাই রে।’’ কখনও বা চলমান ছায়ার মতো কেউ যেন কবিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে: কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়/কাঁপে হৃদয় তাই রে/গুণগুণিয়ে গাইরে।’’ এ যাবৎ ঐ মুহূর্তটি পাওয়ার জন্য কবি যেন সোনার হরিণের পিছু পিছু ছুটেছেন। তাকে কিছুতেই ধরতে পারছেন না অথচ পিছুও ছাড়ছেন না।
সে যে চম্কে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় যায় না তারে বাঁধা/সে যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে লাগায় চোখে ধাঁ ধাঁ/আমি ছুটবো পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই/আমি আপন মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই।’
এবার সেই সোনার হরিণ নিজেই ধরা দিতে এসেছে। তাকে কোমল করে কঠিন বাঁধন পরাতে হবে:
‘‘এবার সখি সোনার মৃগ দেয় বুঝি দেয় ধরা/আয় লো তোরা পুরাঙ্গনা, আয় সবে আয় ত্বরা। ছুটেছিলো তিয়াস ভরে মরীচিকা বারির তরে ধরে তারে কোমল করে কঠিন বাঁধন পরা।’’ এ এক অতিন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। তাই গানটির প্রথম ছত্রেই বলা হয়েছে: ‘আমার মনের কোনের বাইরে’ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে। এই অভিজ্ঞতাকেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন- ঞযধঃ ংবৎবহব ধহফ নষবংংবফ সড়ড়ফ রহ যিরপয ধভভবপঃরড়হং মবহঃষু ষবধফ ঁং ড়হ ধহফ বি ংবব রহঃড় ঃযব ষরভব ড়ভ ঃযরহমং. অর্থাৎ বস্তু-জগতের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুর স্বরূপ উপলদ্ধি করার অভিজ্ঞতা বা অতিন্দ্রিয় অনুভ‚তিজাত জ্ঞান। এই অনুভ‚তি বা মুড ইচ্ছে মত সৃষ্টি করা যায় না বা ইচ্ছা করলেই তা পাওয়া যায় না। কবিকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আরেকটি গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
‘সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভক্ষণ হঠাৎ এলে তখনই পাবো দেখা।’
কবির এই অপেক্ষা পরম আনন্দময়। তাঁর এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
‘ততক্ষণ ক্ষণে ক্ষণে/হাসি গাই আপন মনে/ততক্ষণ রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ/আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’
এই আনন্দময় মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করাকে ইংরেজ কবি শেলী এইভাবে বর্ণনা করেছে: জধৎবষু, ৎধৎবষু পড়সবংঃ ঃযড়ঁ, ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ফবষরমযঃ / যিবৎবভড়ৎব যধংঃ ঃযড়ঁ ষবভঃ সব হড়ি / গধহু ধ ফধু ধহফ হরমযঃ ? অনুবাদ: খুব বিলম্বিত, খুবই বিলম্বিত তোমার এই আগমন, হে আনন্দময়ী/আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় আছ এই দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী?
এমনই আনন্দময় মুহূর্তের জন্য অপেক্ষার কথা আরেকটি রবীন্দ্র সংগীতে ব্যক্ত হয়েছে :
‘‘বসে আছি হে/কবে শুনিব তোমার বাণী/কবে বাহিব হইব জগতে/মম জীবন ধন্য মানি।’’
সেই বাণী যখন শুনতে পাবেন তখন কবির পুনর্জাগরণ ঘটবে:
‘কবে প্রাণ জাগিবে/তব প্রেম গাহিবে/দ্বারে দ্বারে ফিরি সবার হৃদয় চাহিবে/নরনারী মন করিয়া হরণ চরণে দিবে আনি।’ পরমাত্মার সাথে কবির মিলন মুহূর্ত এখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। এখন কবি যেন ‘খেয়া’ কাব্যের সেই বালিকা বধূ যে বয়স্ক বরের তোয়াক্কা না করে পুতুল খেলায় মত্ত। গুরুজনেরা বরের সামনে বালিকার এই ছেলেখেলা দেখে আতঙ্কগ্রস্ত, এই ভেবে যে বিরক্ত হবে বর। কিন্তু বরের মুখে স্মিত হাসি। সে জানে এই বালিকা বধূ একদিন বড় হয়ে লজ্জাবতী রমণী হবে।
বালিকারূপী কবি এখন যুবতী। পরমাত্মার সঙ্গে চলছে তার অভিসার। আজ সে তার প্রেমিকের সাথে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে গোপনে বেরিয়ে যাবে। তাই তার যা কিছু ছিল সব নিয়ে পথে এসে বসে আছে। এই রূপকটি কবি ব্যক্ত করেছেন একটি গানে। টপ্পা সুরে রচিত এই গানটি:
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়/আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।
যে জন দেয় না দেখা যায় যে দেখে ভালবাসে আড়াল থেকে।
আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালবাসায়।
কবি রবীন্দ্রনাথ যে পরমাত্মার জন্য অপেক্ষা করছেন সে এখন কবির মনোজগতে এসে বসবাস করছে। বাউল কবিগণ একে বলেছেন মনের মানুষ, আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- গোপন-বাসী অর্থাৎ গোপনে যে দেহের মধ্যে বাস করে। এই দেহতত্ত¡ রবীন্দ্র-সংগীতে পাশ্চাত্য রীতিতে ধ্বনিত হয়েছে:
আমি কান পেতে রই/ও আমার আপন হৃদয় গহনদ্বারে কান পেতে রই।
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসি শুনিবারে/বারে বারে কান পেতে রই।
ভ্রমর সেখা হয় বিবাগী/নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে/কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গী বিহীন অন্ধকারে/বারে বারে কান পেতে রই।
আরও সহজ করে পুরোপরি বাউলাঙ্গে রচিত অন্য আর একটি রবীন্দ্র-সংগীত:
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকলখানে।
আছে সে নয়নতারায় আলোক ধারায়
তাই না হারায়/আমি তাই দেখি তায়
যেথায় সেথায়/তাকাই আমি যেদিক পানে।
রবীন্দ্রনাথের Ñ রোমান্টিকতা এইভাবে আধ্যাত্মিক মার্গে উন্নীত হয়েছে এবং লীলবাদে পরিণতি লাভ করেছে। এই লীলবাদ আবর্তন কবিতায় Ñ তিনি ব্যক্ত করেছেন এইভাবে :
ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে
সুর আপনারে ধরা দিতে চায় ছন্দে
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ
রূপ পেতে চায় ভারের মাঝারে ছাড়া
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
গানেও রীবন্দ্রনাথ এই লীলবাদ আরও নিবিড়ভাবে ব্যক্ত করেছেন:
তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালবাসার ধন/দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন।
ওগো তুমি আমার নও আড়ালের/তুমি আমার চিরকালের/ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে অদর্শন।