Site icon suprovatsatkhira.com

পানি উন্নয়ন বোর্ডের আর প্রয়োজনীয়তা নেই

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক মো. আনিসুর রহিম। সাতক্ষীরা শহরের সিলভার জুবলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, ১৯৬৯ সালে পিএন স্কুল থেকে বরগুনা উচ্চ বিদ্যালয়ে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ১৯৭২ সালে মাধ্যমিক, ১৯৭৪ সালে যশোর এমএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও পরে অর্থনীতিতে অনার্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন। কর্মজীবনে সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজে চার বছর, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, দেবহাটার খান বাহাদুর আহছান উল্লা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাতক্ষীরা দিবা নৈশ কলেজে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রের সম্পাদক ও প্রকাশক। পাশাপাশি সাতক্ষীরার মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনায় সবসময় রাজপথ কাপিয়েছেন আন্দোলন সংগ্রামে।‘সাতক্ষীরার নাগরিক সমস্যা ও সম্ভাবনা’ বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন সুপ্রভাত সাতক্ষীরার সাথে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বাহলুল করিম, এসএম নাহিদ হাসান ও নুরুল হুদা-

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: কেমন আছেন?
মো. আনিসুর রহিম: আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। তোমাদের ‘সুপ্রভাত সাতক্ষীরা’ নামটা আমার ভাল লেগেছে। যে কোন কিছুর সাথে সাতক্ষীরা থাকলে আমার খুব ভাল লাগে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আপনার জন্মস্থান, আদি বসতি ও পরিবার-পরিজন সম্পর্কে জানতে চাই-
মো. আনিসুর রহিম: ১৯৫৫ সালের ৭ই মার্চ নড়াইল শহরে আমার জন্ম। বাবা আরিফুর রহিম তখন নড়াইলে রেভিনিউ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মা তায়েমা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। নয় ভাই-বোনের মধ্যে আমি পঞ্চম। আমার উপরে চারজন ও আমার নিচে চারজন আছে। পিতৃভূমি ও মাতৃভূমি ভারতের বর্ধমানে। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে। আমরা সব ভাই-বোন বাংলাদেশেই জন্মগ্রহণ করেছি। পরে আব্বারা আর ভারতে ফিরে যাননি। এ কারণে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে রয়ে গিয়েছি। আমার মনে আছে আমার মা তায়েমা খাতুন ছাগলের নাদি পর্যন্ত ঝাড়– দিয়ে এক জায়গায় করে শুকাতেন। পরে সেগুলো জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতেন। গাছের পাতা আমাদের কুড়িয়ে আনতে বলতেন। রান্না থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ আমাদের সব ভাই-বোনদের করতে হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তখন রবিবার সরকারি ছুটি থাকত। বাড়ির সামনের ড্রেন পর্যন্ত আব্বা আমাদের দিয়ে পরিষ্কার করাতেন। কেননা এটা দেশের কাজ। তোমার বাড়ির সামনে পরিষ্কার করার দায়িত্বটা তোমার। যে কারণে আমার বাড়ির সামনে এখনো পানি জমে না। কারণ আমি ওই কাজগুলো করি। ছেলে-মেয়েদের একসাথে নিয়ে আমি এই অঞ্চলটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। আমার আব্বা-আম্মার কাছ থেকে এগুলো শিখেছি। ১৯৮১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। সাংসারিক জীবনে দুই ছেলের বাবা আমি। ১৯৭৮ সালের ৮ মার্চ আমার আব্বা মারা যান। আর আম্মা মারা যান ১৯৯৬ সালের ২ ফেব্রæয়ারি।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আপনার শিক্ষাজীবন-
মো. আনিসুর রহিম: ১৯৬১ সালে বগুড়াতে শিক্ষা জীবন শুরু। ১৯৬২ সালে সাতক্ষীরার সিলভার জুবলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। নবম শ্রেণি পর্যন্ত সাতক্ষীরার পিএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। ১৯৬৯ সালে বরগুনাতে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। এই স্কুলে আমি স্কাউটের সাথে যুক্ত হই। আমি তখন স্কাউটিংয়ে ড্রাম বাজাতাম। স্কাউটিংয়ে মোটামুটি নেতৃত্ব দান করার ক্ষমতা হয়েছিল তখন। এখান থেকে টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করার পরে আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি- ঠিক সে সময় শুনতে পেলাম ৭ মার্চের ভাষণ। ভাষণ শুনে আমরা ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হই। যদিও আমরা আওয়ামী লীগের সংগঠন ছাত্রলীগ করতাম না। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের কর্মীরা আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতাম। থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর মাত্র ২০ রাউন্ড গুলি সম্বল ছিল। আমাদেরকে সেল বোম বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বরগুনাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশনে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতার ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছিলাম ও ৩৬টি পোস্টার মেরেছিলাম। এরপর ১৯৭২ সালে আব্বা যশোরে শিফট হন। ১৯৭২ সালে যশোর এমএম কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই। এমএম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছি।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: পেশাগত জীবন-
মো. আনিসুর রহিম: আমি আসলে ১৯৭৪ সাল থেকে পার্ট টাইম কাজ করার জন্য চেষ্টা করতাম। মানে খবরের কাগজ কিনে বিক্রি করা। মূলত কেউ যদি বলে হকারি করা তাহলে সেটা আমি করেছি। ছাত্র জীবনে অবসর সময়ে এগুলো করতাম। তারপরে যখন অনার্স পরীক্ষা দেব তখন আব্বার কাছ থেকে টাকা চাইতে গিয়ে শুনতে পেলাম এ মাসটা কীভাবে চলবে, ওকে যে কীভাবে ১৩০ টাকা দেব। আমি পাশের ঘর থেকে শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তাহলে তো আব্বার কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না। যশোরে ফিরে এসে আমি টিউশনি শুরু করলাম। টিউশনি শুরু করে আমি নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতে লাগলাম। তারপরে আব্বা মারা গেলেন। সে সময়ে আমার মেঝ ভাই বিদেশ চলে গেলেন। তারপরে আমাদের আর পিছনে তাকাতে হয় নি। ১৯৮০ সালে যশোর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে যোগদান করি। তখন আমার এমএ পরীক্ষার রেজাল্ট হয় নি। ওইখানে আমি ছয় মাস চাকরি করি। এখান থেকে ড্রাফ্ট করা, চিঠিপত্র লেনদেন করা মানে অফিসিয়াল সব ধরণের কাজের একটা প্রাথমিক ধারণা পাই। যদিও বেতন ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। এরপরে ৭৫০ টাকা বেতনে ‘নিজেরা করি’ নামক একটি এনজিওতে যোগদান করি। এনজিওতে থাকাকালীন আমি সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। তখন সাতক্ষীরা মহিলা কলেজে সরকারি হয়নি। ১৯৮৭ সালে আমি খান বাহাদুর আহছান উল্লা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। চার বছর আগে আমি সাতক্ষীরা দিবা নৈশ কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অবসরে যাই। ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। বর্তমানে এই স্কুলের পরিচালকের দায়িত্বে আছি।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: রাজনীতি করতেন-
মো. আনিসুর রহিম: ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে যশোর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলাম। এরপর সিপিবি, ক্ষেতমজুর সমিতি, ভূমিহীন সমিতি, উদীচী, মহিলা পরিষদ ছাড়াও খেলাঘর, আজাদী সংঘ, পলিপ ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি সংগঠনে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯৯০ সালের পর আর কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়নি। সাতক্ষীরা জেলায় পুনঃআগমনের পূর্বে যশোর-খুলনার বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও উপসম্পাদকীয় লিখতাম।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আপনি দীর্ঘদিন দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র সম্পাদনা করেছেন। একটি পত্রিকা অর্থাৎ গণমাধ্যম জনগণের জন্য কীভাবে কাজ করতে পারে-
মো. আনিসুর রহিম: ১৯৮০-৮১ সালে প্রথমে সাপ্তাহিক দখিনায়ন পত্রিকায় কাজ শুরু করে পরে দৈনিক কাফেলাতে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। ১৯৯৬ সালের শুরুতে দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭-৯৮ সাল পর্যন্ত সম্পাদক এবং পরবর্তীতে তিন বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। দৈনিক সাতক্ষীরার চিত্র প্রকাশনার ভিতর দিয়ে সাতক্ষীরার সর্বস্তরের মানুষের ভিতর এক গণজাগরণ সৃষ্টির পথ রচিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. আলাউদ্দিন হত্যাকাণ্ডে, ১৯১৮ সালে ভূমিহীন জনপদে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টিতে দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রসহ অপরাপর গণমাধ্যমসমূহ এক দৃষ্টান্তমূলক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম যে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রের প্রতিটি সংখ্যা তেমনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বিশেষভাবে সাতক্ষীরা চিত্রের ‘খাসখবর’ পড়ার আগ্রহের কথা ভুলবার নয়। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র প্রকশনার কারণে আমার জীবন ও জীবিকার উপর একের পর এক আঘাত আসতে শুরু করেছিল। স.ম. আলাউদ্দিনের খুনিরা ও তাদের রাজনৈতিক প্রভূরা সাতক্ষীরা চিত্রের কাউন্টার হিসেবে নতুন নতুন পত্রিকা প্রকাশ করে এবং সাতক্ষীরা চিত্র স্তব্দ করতে সফলতাও লাভ করেছিল। দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, নারী ও শিশুর প্রতি সহমর্মিতা, আকুতি ও মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় এক বিশেষ অবদান রেখেছিল। বিশেষভাবে ভূমিহীন আন্দোলন, সিরিজ বোমা হামলা, ব্রহ্মরাজপুর পুলিশ ফাঁড়ির অস্ত্র লুট ও উদ্ধারের ঘটনাসহ হাজারো ঘটনায় গণমাধ্যম হিসেবে সাতক্ষীরা চিত্রের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার নাগরিক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাই-
মো. আনিসুর রহিম: সাতক্ষীরা বাংলাদেশের মধ্যে সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। সাতক্ষীরা একটি অবহেলিত উপকূলীয় জনপদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের লেখা-পড়ার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না। এখানে যত আইনজীবী ছিল সব হিন্দু সম্প্রদায়ের। কিন্তু দেশ ভাগের কারণে মুসলমানের যে আধিপত্য ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে টিকতে পারে নি। ফলে জ্ঞানী ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তখন সব ভারতে চলে যায়। পঞ্চাশের দশকের দিকে সাতক্ষীরা নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে। আমার দুর্ভাগ্য যে আজও পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ওই রকম যোগ্যতা সম্পন্ন একজন নেতাও নেতৃত্বে আসতে পারে নি। যারাই এসছে, তারাই সুবিধাভোগী। সুতারাং সাতক্ষীরা এখনও পর্যন্ত নেতৃত্ব শূন্য হয়ে রয়েছে। প্রশাসন তেমন লোককেই আনতে চায় যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে না। বরং তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। সাতক্ষীরা ছিল ৪৩টি নদ-নদী ও হাজার খানেক খালের শহর। ওয়াপদার অপরিকল্পিত বাঁধ ও সুইস গেটের কারণে জলপথটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। তারপরে তৈরি হওয়ার কথা স্থলপথ ও রেলপথ। স্থলপথের দিকে তাকালে দেখা যায় সাতক্ষীরার মতো খারাপ রাস্তা আর কোথাও নেই। উন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। আজকে আমরা দেবহাটার ইছামতি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রেলের হুইসেল শুনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে সাতক্ষীরার কোন উন্নয়ন হয়নি। সরকারি দফতরে কোন ভাল অফিসার আসলে তাদেরকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়া হয় না। এখান থেকে তাদের চলে যেতে বাধ্য করা হয়। আবার যারা টিকতে চাই তারা অনেক কষ্ট করে টিকে থাকে। কিন্তু কোন কাজ করতে পারে না। আজকে রেলপথটা সবচেয়ে জরুরী। রেলপথটা হলে ব্যবসা, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হতো। সাতক্ষীরা জেলার সিংহভাগ হলো সুন্দরবন। কিন্তু পর্যটন বলতে মানুষ বোঝে মংলা টু খুলনা। সাতক্ষীরাকে এখনও বোঝে না। সাতক্ষীরা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে গেলে আমাদের খুলনা খেকে অনুমতি নিতে হয়। আমরা আজও পর্যন্ত এটা করতে পারি নি। এজন্য অনেক সংগ্রাম করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সুন্দরবনে সরকারিভাবে একটা রিসোর্ট তৈরি হবে সেটাও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সাতক্ষীরা এখনও নেতৃত্ব শূন্য হয়ে আছে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে আপনার সম্পৃক্ততা দেখতে পাই- এসব বিষয়ে কাজ করার উৎসাহ/প্রেরণা পেয়েছেন কোথা থেকে-
মো. আনিসুর রহিম: নাগরিক আন্দোলনের প্রেরণা মূলত মুক্তিযুদ্ধ, পরিবার, রাজনীতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও যশোর এমএম কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছি।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: জলাবদ্ধতা সাতক্ষীরার সমসাময়িক সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম। তালা-কলারোয়া-সদর উপজেলার বিভিন্ন অংশ ছাড়িয়ে এখন শহরেও- এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন-
মো. আনিসুর রহিম: এখান থেকে ১৫ বছর আগে টি আর এম প্রজেক্টের মাধ্যমে নদী খননের সুযোগটা ছিল। এখন নদীর তলদেশ এতটাই উঁচু হয়ে গেছে- এখন আর এই নদী খনন করার কোন উপায় নেই। এখন ছোট খাল ও নদী কেটে পানি নিষ্কাশনের কোন রকম ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা নষ্ট হবে। কিন্তু কোন কাজ হবে না। এ কাজটা যে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে। একপাশে খনন করবে আর একপাশে বুঁজে যাবে। আবার যখন এই পাশটা শুরু করবে তখন ওই পাশটা আরো বুজে যাবে। সুতরাং জলাবদ্ধতা আমাদের অদৃষ্টের লেখনে পরিণত হয়েছে। তারপরেও জনগণ কিন্তু নিজ নিজ এলাকায় পানি নিষ্কাশনের জন্য কাজ করছে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে আমাদের স্থানীয় জনগণের উপর নির্ভর করতে হবে, সরকারের উপর না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: শহরেও জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে, এই সংকট তৈরির কারণ কি?
মো. আনিসুর রহিম: আজকে মৎস্য চাষে ব্যাপকভাবে উন্নতি হয়েছে- কিন্তু এর একটা নীতিমালা থাকতে হবে। রাস্তার ধারে প্রায় ২৫-৩০ ফুট সরকারি জমি থাকে। এই জায়গাকে বাদ দিয়ে মাছ চাষ করবে। সে নিজের ঘেরে বাঁধ দেবে। ওয়াপদার বেড়িবাঁধকে ব্যবহার করে মাছ চাষ করতে পারবে না। ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে চাষ করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে রাস্তাঘাট ঠিক থাকবে ও সেখানে আর জলাবদ্ধতা হবে না। বেড়িবাঁধ ভেঙে মানুষ আর ডুবে মরবে না। বেড়িবাঁধের গায়ে যদি মাছ চাষের অথবা দখল করার সুযোগ না দেওয়া হয় তবে জলাবদ্ধতা স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নিরসন হয়ে যাবে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে-
মো. আনিসুর রহিম: জলাদ্ধতা নিরসনের ক্ষেত্রে যদি ইউনিয়ন পরিষদের উপরে দায়িত্ব দেওয়া হয়- যার অঞ্চলের খনন সে করবে। কোন ঠিকাদার চলবে না, কোন ওয়াপদা/পাউবো চলবে না, কোন প্রশাসন চলবে না, কোন বাজেট থাকলে চলবে না। বাজেট যা দিতে হবে ইউনিয়ন পরিষদকে দিতে হবে। তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। সেক্ষেত্রে একটা শর্ত আছে- কোন খাল বা কোন নদী সরকারিভাবে ঢাকা ও খুলনা থেকে অথবা জেলা ও উপজেলা থেকে লিজ দেওয়া যাবে না। লিজ যদি দিতেই হয় তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা দেবে। তাহলে দেখা যাবে যে সবকিছু দায়বদ্ধতার জায়গায় এসে যাবে। তখন জলাবদ্ধতা বলে কোন শব্দ থাকবে না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার মরিচ্চাপ, কপোতাক্ষ, বেতনা আজ মৃতপ্রায়। এসব নদীর প্রাণ ফেরাতে নাগরিক কমিটি কোন ভূমিকা রেখেছে কী না-
মো. আনিসুর রহিম: বদ্দীপুর কলোনীতে কিছু মানুষ মাছ চাষের নামে খণ্ড খণ্ড বেড়ি দিয়ে রেখেছে। ফলে পানি বেতনা নদীতে নামছে না। এ ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন সময়ে স্মারকলিপি দিয়েছি ও মানববন্ধন করেছি। আমরা খুলনাতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলো মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু বাস্তবে কোন ফল দেখা যায় না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা পৌর এলাকার নাগরিক সমস্যা- সুপেয় খাবার পানির সংকট, রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশা, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকা প্রভৃতি সমস্যা নিয়ে নাগরিক কমিটি কী ভাবছে-
মো. আনিসুর রহিম: এ ব্যাপারে পৌরসভার মেয়রের সাথে বসেছি। তিনি বিরোধী দলের নেতা বলে কিছু বলতে পারেন না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: জেলা শহরে বেশ কয়েকবছর ধরে তীব্র যানজট দেখা যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কি সুপারিশ করবেন-
মো. আনিসুর রহিম: পৌরসভা রাস্তার পাশে যে জায়গাগুলো লিজ দিয়েছে- এই লিজগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি রাস্তা যা আছে তার ডাবল করতে হবে। কেননা আগে জনসংখ্যা যা ছিল, তার ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে রাস্তা বাড়ে নি। কিন্তু রাস্তা ৩০ গুণ বাড়া তো দূরের কথা রাস্তার জায়গা দোকনদাররা দখল করে বসে আছে। এটা বন্ধ করতে হবে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে সাতক্ষীরা সদর থানাও উভয় পাশে ছয় ফুট করে পৌরসভার জায়গা দখল করে তাদের প্রাচীর দিয়েছে। তখন আমরা শহরের নাগরিক সমাজ চেষ্টা করেছিলাম প্রাচীর দিতে দেব না। শেষ পর্যায়ে পৌরসভাকে বাধ্য করা হয় তাদের নামে জায়গাটা লিখে দিতে। জোর করে ঠিকাদারদের কাছে টাকা দিয়ে প্রাচীর তৈরি করে নেওয়া হয়। এভাবে যদি পৌরসভার রাস্তার জমি দখল হয়ে যায় তাহলে আমরা যানজট নিরসন করবো কীভাবে। রাস্তা বড় করা ছাড়া এই সমস্যা নিরসন হবে না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: প্রাণ সায়ের খাল- ময়লার ভাগাড়। দখল হয়েছে দু’পাশ। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে শহরের- প্রাণ সায়ের খাল নিয়ে কিছু বলুন-
মো. আনিসুর রহিম: আমাদের বড় ভুল হয়েছে ৮০ এর দশকে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীতে খেজুরডাঙ্গি ও বালিথায় সুইস গেট দেওয়াটা। এরপরে এটা বদ্ধ হয়ে পড়ে, ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রাণ সায়ের খাল আগের থেকে আরও সুন্দর করা যাবে। সেটা হচ্ছে পরিকল্পনা করে খালের সৌন্দর্য বাড়াতে হবে। এতে আমাদের নতুন করে আর পার্কের প্রয়োজন হবে না। মেয়র চিশতি অনেক চেষ্টা করেছে- কিন্তু করতে পারে নি। কেন পারে নি- তা আমি জানি না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: ভোমরা বন্দর দেশের অন্যতম প্রধান বন্দর- পূর্ণাঙ্গ হয়েও হলো না- সব পণ্য আমদানির সুযোগ মেলেনি এখনো- এর মাধ্যমে বিকশিত হতে পারে সাতক্ষীরার অর্থনীতি- বন্দর নিয়ে কী ভাবেন-
মো. আনিসুর রহিম: আমার কাছে একটাই কথা রেলপথ যদি ভোমরা বন্দর পর্যন্ত হয় তাহলে যশোর-খুলনার থেকেও আমাদের সাতক্ষীরা বেশি উন্নত হবে। যখনই ভোমরা দিয়ে রেলপথ ভারত পর্যন্ত যাবে তখনই পণ্য পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে। এতে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাব। মানুষ খুব সহজে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা যেতে পারবে। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা যেতে এখন ১০ ঘণ্টা সময় লাগে কিন্তু কোলকাতা যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। আমাদের সমন্বয়টা এমনভাবে হয়ে যাবে যে সাতক্ষীরাকে কেউ ইচ্ছা করলেও আর পিছিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। রেললাইনের কোন বিকল্প নেই, উপযুক্ত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই- এগুলো করার মাধ্য দিয়ে যোগ্য মানুষ তৈরি করতে হবে। এটা করতে পারলে আমাদের সাতক্ষীরা সত্যিই একটা উন্নয়নের রূপরেখায় পৌঁছে যাবে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: জেলাব্যাপী নদী-নালা-খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলছে-
মো. আনিসুর রহিম: এটা তো আসলে সরকারের আইনে আছে, ৭২ সালের প্রেসিডেন্টের অর্ডারে- যাদের জমি এক একরের কম আছে তাদেরকে ভূমিহীন বলা হতো। এখন শুধুমাত্র যাদের ভিটেবাড়ি আছে বা কোন নিজস্ব জমি নেই তাদের ভূমিহীন বলা হয়। ভূমিহীনরা কিন্তু সাংঘাতিক পরিশ্রমী। এদের হাতে যদি ৭২ সালের আইন অনুযায়ী খাস জমি দেওয়া হয় এবং সরকার যদি ঘোষণা করে এক একর আবাদি খাস জমি আর খাস খতিয়ানে থাকতে পারবে না, যে কোন মূল্যে ভূমিহীনদের মাঝে বিক্রয়ের অযোগ্য শর্তে বন্দোবস্ত দিতে হবে- এটা করা গেলে এই দখলের প্রতিযোগিতা হয়ত বন্ধ হবে। কিন্তু দেখা যায় যে, এই খাস জমিগুলো বিত্তবানদের কাছে থাকে। তারা নায়েবদের পয়সা দিয়ে এই জমি নিজেদের আয়ত্তে¡ রাখে। বিত্তবানরা এই খাস জমি নিজেদের দখলে রাখে কারণ এটা থেকে তারা বড় ধরণের একটা আয় পায়। কিন্তু এই খাস জমি যদি গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয় তাদের দারিদ্র্য বিমোচন হবে। তাদের ছেলে-মেয়েরা ভাল শিক্ষা পেয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। দশ বছরের মধ্যে দেখা যাবে সমস্ত জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসাথে দরিদ্র মানুষ তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে। এটাও রাজনৈতিক ভূমিকা ছাড়া সম্ভব না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে উপক‚লীয় মানুষ আতংকে থাকে সবসময়- পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই- এসব বিষয় নিয়ে নাগরিক কমিটি কী ভাবে-
মো. আনিসুর রহিম: পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে আর নেই। স্থানীয় সরকার এবং এলজিডির মাধ্যমে যদি আমরা বেড়িবাধ সংস্কার করি ও রক্ষণাবেক্ষণ করি তাহলে ওই বেড়িবাঁধ কখনও নষ্ট হবে না। এ জায়গা সৃষ্টি করতে হলে ওয়াপদাকে নিষ্ক্রীয় করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে যারা কর্মরত, তাদেরকে অন্যত্র চাকরি দিতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে দিয়ে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। আজও মনে হয়, আমরা এগুলো করতে পারবো। এই প্রস্তাব কিন্তু তত্ত¡াবধায়ক সরকার গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আর তা হয়ে ওঠেনি।
আর স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বেড়িবাঁধের পাশে যে বসতি গড়ে উঠছে- তাদের এমনিতে বসবাস করতে না দিয়ে যদি দুই বছর মেয়াদী ডিসিআর কেটে তাদের বসবাস করতে দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ইউনিয়ন পরিষদগুলো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হবে। সরকারের রেভিনিউ বাড়বে। আমি এ জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ডিসি বরাবর একটি প্রস্তাব করি। বেড়িবাঁধের দুই পাশের জমি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লিজ দেওয়া হবে। লিজের ৫% পাবে সরকার, ১০% পাবে জেলা পরিষদ, ১০% পাবে উপজেলা পরিষদ ও বাকি ৭৫% পাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। তারাই সব রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তাহলে দেখা যাবে সরকারের প্রচুর আয় বেড়ে যাবে। এই অর্থ দিয়ে নদী খনন ও খাল খনন করে বিরাট একটা সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হবে। যেটা পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে হয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে হয়েছে। সুতরাং আমাদের সে পথে হাটতে হবে। যে পথে আমাদের এক খণ্ড জমিও পতিত থাকবে না।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার ভ‚মিহীন আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন-
মো. আনিসুর রহিম: ১৯৮৮ সালে ভূমিহীন আন্দোলনের জন্য ৬ মাসের জেল খেটেছি। ১৯৯৮ সালে আন্দোলনের ফলে দেবহাটায় সাত হাজার একর জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আন্দোলন সংগ্রামে কখনও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন-
মো. আনিসুর রহিম: আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে এক বার জেল খেটেছি। বহুবার বহু বাঁধার মধ্যদিয়েই এগিয়েছি।

সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আন্দোলন সংগ্রামের মূল লক্ষ্যই তো ‘স্বপ্নের সাতক্ষীরা’ গড়া- কেমন সাতক্ষীরার স্বপ্ন দেখেন-
মো. আনিসুর রহিম: একদিন এই সাতক্ষীরা সকল মানুষের বাসযোগ্য সাতক্ষীরা হবে। সুন্দর সাতক্ষীরার স্বপ্ন দেখি।
সুপ্রভাত সাতক্ষীরা: আপনাকে ধন্যবাদ-
মো. আনিসুর রহিম: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version