Site icon suprovatsatkhira.com

দখলের রামরাজত্ব: সরু নালায় পরিণত প্রমত্তা মরিচ্চাপ দায়ী অপরিকল্পিতভাবে খননও

গাজী আসাদ ও ফাহাদ হোসেন: এক সময়ের প্রমত্তা মরিচ্চাপ নদী এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। স্থানভেদে ১৫০-২০০ মিটার চওড়া নদীটি এখন সরু নালা। নদীর দুই পাশ দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা-পাঁকা বাড়ি, ঘের, ইট ভাটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। নদীটির সিংহ ভাগই এখন দখলকারীদের কবলে। এতে নাব্যতা হারিয়ে নদীটি এখন মৃত প্রায়। আর তার নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশগত নানা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে, দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অনেকেই এক সময়কার প্রমত্তা মরিচ্চাপ নদীর নাম বদলে নালা বলতে শুরু করেছেন। তবে, এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ক’দিন পর তাও অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশংকা করছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্থানভেদে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া মরিচ্চাপ নদী এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। সামান্য পানি নিয়ে মরিচ্চাপ নদীর সাক্ষ্য দিচ্ছে নালাটি। দেবহাটা থেকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে আশাশুনি উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মরিচ্চাপের পুরোটাই চলে গেছে দখলকারীদের কবলে। বিলশিমুলবাড়িয়া, বালিথা, চরবালিথা, এল্লাচর, ফিংড়ী, ব্যাংদহ, টিকেট, কামালকাটি, নইহাটি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর দু’ধারে চলছে দখলের মহোৎসব। মূল নদীর দু’ধারে বেড়ির মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য পাঁকা-কাঁচা বাড়ি, ধর্মীয় স্থাপনা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ইটেরভাটা, মুরগির খামার, ঘেরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীটি খননের নামে চলেছে নদীকে মেরে ফেলার উৎসব। খননের সময় নদীর মধ্যভাগ হতে মাটি তুলে নদীর মধ্যেই দু’পাশে বেড়ির উপর রাখা হয়েছে। এতে ৮-১০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে মরিচ্চাপ।
নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী জানান, এক সময় মরিচ্চাপ ছিলো খর¯্রােতা। এতে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হতো। মরিচ্চাপ ছিলো স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার উৎস। এই নদী দিয়ে চলতো বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার, পাল তোলা নৌকা। আর এই নদী দিয়ে সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ কলকাতায় যেতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। আশাশুনি, দেবহাটা এবং সদরের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার অন্যতম প্রধান পথ ছিলো এই নদী। বিশেষ করে সাতক্ষীরা শহরে আসতে এই নদীই ছিলো প্রাণসায়ের খালে প্রবেশের পথ। খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের রুট ছিলো এটি। নদীটির সাতক্ষীরা সদরের এল্লারচরে ছিলো স্টিমার ঘাট। ভাঙা-গড়ার দৃশ্য দেখা যেত নদীর দু’পাড়ে। দু’ধারে নদীকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ফসলের মাঠ ছিলো। নদীতে রাত-দিন মাছ ধরে সংসার চালাতো তীরবর্তী মানুষ। এছাড়া অনেক জায়গায় খেয়াঘাট ছিল। কিন্তু আজ সবই স্মৃতি। নেই স্টিমার ঘাট, খেয়া ঘাট, পাল তোলা নৌকার সারি, মাছ ধরা নৌকা। জোয়ার-ভাটা খেলা নদীটির বুক দখল করে এখন নির্মাণ হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা।
স্থানীয়রা জানায়, বছর সাতেক আগে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিজি) আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত¡াবধানে নদীটি খননের কাজ করা হয়। ওই সময় অপরিকল্পিকতভাবে নদীর ধার চেছে ছুলে সেই মাটি নদীর মধ্যেই ফেলে বেড়িবাঁধ উঁচু করা হয়। খননের সময় নদীর ভেতর থেকে মাটি তুলে নদীর দু’ধারের ১০ মিটার জায়গায় উঁচু করায় ১০ মিটারের বাইরে নদীর যে জায়গা ছিলো তা খুব দ্রæত দখল হয়ে যায়। এখন নদীটি কোথাও কোথাও সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া ষাটের দশকে নদীটির বাকে বাকে অপরিকল্পিতভাবে ¯øুইচ গেট করায় খালগুলোর পানি প্রবেশ ও পানি বের হতে না পারায় জোয়ারে আসা পলি নদীর বুকে জমে যাওয়ায় নাব্যতা হারায় নদীটি। ফলে এখন আর জোয়ার-ভাটা হয় না। তার উপর আবার নেট-পাটা ও অবৈধ বাধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
এল্লারচর এলাকার নওশের আলী (৭০) জানান, মরিচ্চাপ ছিলো আমাদের প্রাণ। এই নদী আর আগের নদী কল্পনা করলে রূপকথা মনে হয়। নিজেরই বিশ্বাস হয় না এখানে এতো বড় নদী ছিলো। এই নদীতে জোয়ার ভাটা হতো। প্রচুর স্্েরাত ছিলো। নদীতে নামতেই ভয় লাগতো। যখন নদীতে বান আসতো তখন অনেক দূর থেকে শব্দ শোনা যেতো। এল্লারচরের এখানে স্টিমার ঘাট ছিলো। আমরা এটা দিয়ে পার হয়ে শহরে যেতাম। আবার নৌকায় করে সায়ের খাল হয়ে শহরের যেতাম। নদীতে বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার চলতো। আমাদের বাপ-দাদারা এই নদী দিয়ে কলকাতা, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করতে যেতেন।
তিনি আরো জানান, এখন সেই নদী আর নেই। ১৫০-২০০ মিটার চওড়া নদী দখল হতে হতে ছোট নর্দমায় পরিণত হয়েছে। নদীর বুক দখল করে ভ‚মিদস্যুরা ঘের, বাড়ি, ভাটা করেছে। নদী কাটাতে যেয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
ফিংড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সামসুর রহমান জানান, নদীর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে। ভ‚মি অফিসের কিছু কর্মকর্তার কারণে এটা হয়েছে। নদীটি খননে যদি ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দিয়ে এলাকার মানুষ দিয়ে করা হয় তবে কিছুটা কাজ হবে। আর নদীর জায়গা দখল থেকে রক্ষা পেতে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সাতক্ষীরা নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতা অধ্যক্ষ আশেক-ইলাহী জানান, মরিচ্চাপ নদীটি দখল হয়ে গেছে। এটা এখন মরা খাল। এটা রক্ষায় তেমন কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নদী দখল মুক্ত করতে নদীর জায়গা মাপ করা দরকার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এটা কখনো করেনি। মরিচ্চাপ রক্ষা করতে দ্রæত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনিসুর রহিম জানান, মরিচ্চাপ নদী ঘের মালিকদের দখল এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলার কারণে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এই নদী এমন ছিলো না। আমরা এই নদী দিয়ে চলাচল করেছি। এই নদী দিয়ে খুলনা, কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকায় যেতাম। এখানে জোয়ার ভাটা হতো। কিন্তু এখন এটা দখল হতে হতে সরু খালে রূপ নিয়েছে। কয়েকবার নদীটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু খননের নামে ঠিকাদারদের দিয়ে লুটপাট করে পরিকল্পিতভাবে নদীকে মারা হয়েছে। আর এখন চলছে দখলের রাজত্ব।
তিনি আরো জানান, এখন আর পানি উন্নয়ন বোর্ড দিয়ে খনন করালে হবে না। তাহলে আবার লুটপাট করা হবে, কিন্তু নদী খনন হবে না। এক্ষেত্রে নদী এলাকার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নকে দিয়ে খনন করাতে হবে। এবং তাদের দ্বারা দখল রোধে পরিকল্পি ভাবে জমি বণ্টন করলে তাহলে নদীটি রক্ষা পাবে। নদী পাড়ের ঘের, ইট ভাটাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় উচ্ছেদে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদীটি রক্ষা করতে একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে থাকা নদীর ৩৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় নদীর স্থান বিশেষ ৩২ থেকে ৫৫ মিটার চওড়া করে খনন করা হবে। স্থান ভেদে বর্তমান গভীরতার সাথে আরো চার থেকে পাঁচ মিটার গভীর করা হবে। এই প্রকল্পে পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় থাকা ৩৪ দশমিক ৫ কিলোমিটারের জন্য ৯৫ কোট ২৬ লক্ষ টাকা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় থাকা ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটারের জন্য ২৪ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, নদীর পাড়ের জমি আমাদের না। এটা জেলা প্রশাসনের আওতায়। তাই এই জায়গা রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের। তবে আমরা নদীটি খননের জন্য এটা প্রকল্প তৈরী করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পাশ হলে খুব দ্রæত খননের কাজ শুরু হবে।

https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/
Exit mobile version