আব্দুল কাদের
ইভটিজিং বর্তমান সময়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। যা রাষ্ট্রের গোটা প্রশাসন যন্ত্রকে ভাবিয়ে তুলছে। কিছুদিন পূর্বে যেমনটি ছিল এ্যানথ্যাক্স এবং বার্ড ফ্লু। প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ বাইবেল থেকে ইভ শব্দটি এসেছে যার অর্থ নারী। আর টিজিং শব্দের অর্থ উত্ত্যক্ত অর্থাৎ নারীকে উত্ত্যক্ত করা বা একজন মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই একটি ইভটিজিং এর খবর পাওয়া যায়। বিষয়টি দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। কোন অবস্থাতেই যেন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফাহিমা, রিমা, পিংকি, আলেয়া থেকে শুরু করে এ যাবৎ প্রায় অর্ধ শতাধিক মেয়ে জীবন দিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। চাপা রানীসহ আরো কয়েকজন অভিভাবক এই করুন অবস্থার প্রতিবাদ করতে না পেরে ক্ষোভে দুঃখে এ ধরা থেকে বিদায় নিয়েছেন।
সর্বশেষ প্রতিবাদকারী শিক্ষক নাটোরের মিজানুর রহমান যার করুন মৃত্যু গোটা শিক্ষক সমাজকে রাজ পথে নামিয়েছে, করেছে ঐক্যবদ্ধ। দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা এমন কি একে বারে গ্রামগঞ্জের শিক্ষকরাও প্রতিবাদের ভাষায় ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ইভটিজিং? কারা এই টিজার? কী তাদের পরিচয়? তাদের সংখ্যাই বা কত? তাদের শক্তির উৎসই বা কি? আর কারা টিজিং এর শিকার? কি তাদের অপরাধ? আর কত কাল চলবে এই অবস্থা বা এর শেষ পরিণতি কোথায়? এমনই হাজার প্রশ্ন সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের।
এখন আমরা এই সামাজিক ব্যাধির কারণ অনুসন্ধান করব। মানুষ সামাজিক জীব সমাজের বাইরে তার অবস্থান সম্ভব নয়। আর এই প্রথার প্রধান ইউনিট হচ্ছে পরিবার। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে একজন শিশুর প্রথম এবং প্রধান বিদ্যাপীঠ। আর তার শিক্ষক হচ্ছে পিতামাতা এবং অন্যান্য সদস্যরা। এই পরিবার থেকেই সে নানা বিষয়ের শিক্ষা লাভ করে। কোন শিশুর পিতা যদি বাইরে থেকে এসে তার বাচ্চাকে সালাম দেয়, তবে ওই শিশুও সালাম দেয়া শেখে। আর কোন পিতা যদি বাসায় ঢোকার সময় সিগারেট হাতে নিয়ে বাসায় ঢোকে, তাহলে ওই শিশুও মনে করে, বড় হয়ে বাসায় ঢোকার সময় সিগারেট হাতে নিয়ে ঢোকা একটা স্টাইল। তেমনি মায়ের আচার-আচরণ কথা-বার্তা চাল চলন সবকিছু শিশুকে প্রভাবিত করে। শুধু পিতা-মাতা নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আচার আচরণ চালচলনও শিশু অনুকরণ করে। কারণ শিশু প্রথমে বড়দের দেখে শেখে, বড়দের অনুসরণ করে। এটা শিশুর সহজাত বৈশিষ্ট্য। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে পরিবারের সবাই কর্মব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট সময় মা বাবা উভয়ে কর্মক্ষেত্রে চলে যাচ্ছে, দিন শেষে বা রাতে তারা ঘরে ফিরছে আর সে ক্ষেত্রে শিশু সারাদিন কাটাচ্ছে বাড়ির কাজের লোক বা অন্য কারো কাছে। পিতা-মাতার নিকট থেকে সে কাক্সিক্ষত সময় পাচ্ছে না। শিশুর নেই কোন খেলার সঙ্গী, সে বাইরের উন্মুক্ত পরিবেশে অন্যশিশুদের সঙ্গে পাচ্ছে না খেলার সুযোগ, পাচ্ছে না সহপাঠী বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবেশ। ইট কাট পাথরের চার দেওয়ালের মধ্যে সে অবসর সময় কাটায় টিভি দেখে কম্পিউটারে গেমস খেলে বা অন্য কোনভাবে। এভাবে একাকি বেড়ে ওঠা শিশুরা কোন কোন ক্ষেত্রে হচ্ছে হিংস্র ও দয়ামায়াহীন। কারণ কম্পিউটার আর ভিডিও গেমগুলো তাকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে বেড়ে ওঠা শিশুরা স্কুলের গÐি পেরিয়ে কলেজের আঙিনায় পা দিয়ে ইভটিজারদের দলে যোগ দিচ্ছে। আজ কাল অভিভাবকেরা এতটা ব্যস্ত যে তার আদরের সন্তানটি শিক্ষা অঙ্গনে বা বাইরে গিয়ে কি করছে? কখন ঘর থেকে বের হচ্ছে, আবার কখন ঘরে ফিরছে? বন্ধুদের সাথে সে কি করছে- তার খোঁজ খবর নেয়ার সময় তাদের নাই।
সম্প্রতি পত্রিকায় ‘বিষাক্ত মদ পানে কুয়েটের দুই ছাত্রের মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদ এসেছে। ঘটনাটা এমন যে কুয়েটের চার মেধাবী ছাত্র কুষ্টিয়ায় এক বন্ধুর বিয়েতে যায়, সেখানে তারা বিষাক্ত মদ পান করে। এর মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে একজন কুয়েটের একটা ছাত্র সংগঠনের সভাপতি। এই মৃত্যুর দায়ভার কে নিবে, পরিবার? সমাজ না রাষ্ট্র? বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। না সমাজ না রাষ্ট্র। পরিবার প্রথা দুর্বল হওয়ায় কারণে, পারিবারিক বন্ধন না থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে। আর গোটা দায় গিয়ে পড়ছে রাষ্ট্র যন্ত্রের উপর। যা রাষ্ট্রের পক্ষে সামাল দেয়া বড়ই কষ্টকর।
দ্বিতীয়ত, নৈতিক শিক্ষার অভাব। পিতা-মাতা এবং গুরুজনকে সালাম ও সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, মিথ্যা না বলা, অপরের দ্রব্য না বলে নেয়া, অসহায় দুঃখী মানুষকে সাহায্য করা, প্রতিবেশীর সাথে সু-সস্পর্ক রাখা, আত্মীয়তায় সম্পর্ক ছিন্ন না করা- এ ধরনের শিক্ষা না থাকার কারণে আমাদের শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। এক সময় শিশুর হাতে খড়ি হতো-সদা সত্য কথা বলব, মিথ্যা বলা মহাপাপ, সকলে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন যেন আমি ভাল হয়ে চলি—-ইত্যাদি আরও অনেক নীতি বাক্য দিয়ে। এখন শিশুর হাতে খড়ি হয় “হাট টিমা টিম, টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম, আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে ইত্যাদি বাক্য দিয়ে। শুরুতে শিশুর মধ্যে আগডুম বাগডুম ঢুকিয়ে তার ব্রেনকে ধোলাই করা হয়। আজ আমরা ভুলে গেছি, দিল্লীর বাদশা আলমগীরের পুত্রের নিজ হাতে ওস্তাদের পায়ে পানি ঢেলে দেওয়া এবং পরবর্তীতে বাদশা কর্তৃক শিক্ষককে তলব, কেন তার পুত্র নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিল না? যা কবির ভাষায়, “আজি হতে চিরউন্নত হলো শিক্ষা গুরুর শির” শিক্ষকদের সেই মর্যাদা আজ আর নেই। অথবা বায়েজিদ বোস্তামির গভীর রাতে মায়ের তৃষ্ণা মিটানোর জন্য বাহির থেকে পানি এনে সারারাত মায়ের শিয়রে দাড়িয়ে থাকার ঘটনা। আমরা আজ ভুলে যেতে বসেছি। শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক, মাতা ও পুত্রের সম্পর্ক সে সময় যা ছিল, আজ তার চিত্র ভিন্ন রূপ। আজ থেকে প্রায় ১ বছর আগে ঢাকার একজন উচ্চ পদস্থ আমলার ছেলেকে তার মা ভাড়াটিয়া কিলার দ্বারা হত্যা করান। ওই আমলার মৃত্যুর পর ছেলের অত্যাচারে মা এতটা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন যে, একপর্যায়ে তিনি তার নিজ ছেলেকে ভাড়াটিয়া কিলার দ্বারা হত্যা করান। হত্যার পর যখন কিলার চলে যায়, কিছুক্ষণ পর মা দেখেন তখনও ছেলে পুরোপুরি মরেনি। তিনি আবার মোবাইল ফোনে তাদের ডেকে মৃত্যু নিশ্চিত করান। একজন মা কখন তার ছেলেকে হত্যা করান? বিষয়টি যে কোন বিবেকবান ব্যক্তির হৃদয়ে কিছুটা হলেও নাড়া দিবে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে এমনটি হচ্ছে।
তৃতীয়ত, মাদকাসক্তি ইভটিজিং এর একটি মূখ্য কারণ। মাদকের সহজ প্রাপ্তি ও সহজলভ্যতা যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত যুবক তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। বন্ধুদের সাথে মিশে ইভটিজিং, চুরি, ড়াকাতি, ছিনতাই করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে মাদক সেবীর সংখ্যা ৬৫ লাখের বেশী। যাদের বয়স ১৫ হতে ৩৫ এর মধ্যে। জাতিসংঘের এন্ট্রি ড্রাগ ক্যাম্পেইন সংস্থার হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। দিনদিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
চতুর্থত, বেকরত্ব ইভটিজিং এর অন্যতম কারণ। কথায় বলে অলস মস্তিক শয়তানের আড্ডাখানা। দেশে বর্তমানে ৪ কোটি ১৫ লাখ বেকার রয়েছে, যাদের কাজ করার ইচ্ছা আছে কিন্তু কাজ পাচ্ছে না। প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করে ২৭ লাখ কর্মক্ষম যুবক কিন্তু কাজ পায় মাত্র ১৬ লাখ, আর বেকার থাকে ১১ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক কর্মহীন যুবক সন্ত্রাস ছিনতাইসহ অংশ নেয় ইভটিজিং এর মত অসামাজিক কার্যক্রমে।
পঞ্চমত, উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও অশ্লীল ছায়াছবি আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজ আর পয়সা খরচ করে সিনেমা হলে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, ঘরে বসে তারা করুচিপূর্ণ ছবি, ভিডিও দেখে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে।
ষষ্ঠত, তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ইভটিজিংয়ের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং এর মাল্টিপারপোজ ব্যবহার ইভটিজিংকে আরও সহজ করে তুলছে। মোবাইল ফোনে ছবি তুলে তা এডিটিং, কুরুচিপূর্ণ ছবি এসএমএসসহ ই-মেইল, ফেসবুক, ইউটিউব এর মত তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধায়ও কম ফেলেনি- যার শত শত প্রমাণ রয়েছে। অবশ্য তার জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা যায় না, দায়ী ব্যবহারকারী। এই সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াধী পরিকল্পনা প্রয়োজন। অবশ্য বর্তমান সরকার আইনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু আইন দিয়ে মানুষকে সবকিছু থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। আশু ব্যবস্থা হিসেবে ইভটিজারদের শাস্তির পাশাপাশি তাদের সংশোধনের জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। তাদের অভিভাবকদের ডেকে সচেতনতা বৃদ্ধি, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন, এনজিও ও সুশীল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষার বিষয় অর্ন্তভুক্তি, ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ, বেকার যুবদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির ছোবল রোধ, তথ্যপ্রযুক্তিকে মানব কল্যাণে ব্যবহারের কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ, মাদকের সহজলভ্যতা ও মাদক আমদানি নিষিদ্ধ করা- সর্বোপরি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আসুন আমরা সকলে মিলে একযোগে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত গঠনের লক্ষ্যে এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই। লেখক: সহকারি পরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা।