জুলাই ২৯, ২০১৮
আদি যমুনা-ইছামতি আখ্যান: সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা ও নদী ব্যবস্থাপনা
অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী দক্ষিণে সাগর। সাগর পাড়ে সুন্দরবন। অসংখ্য নদী সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান। যা সাগর থেকে উৎপত্তি এবং সুন্দরবন সংলগ্ন। এ নদীসমূহ উত্তর মুখে সাগরের জোয়ারের বর্ধিত পানি নিয়ে ধাবিত হয়েছে। আবার সাগরের ভাটার টানে উপরের সকল পানি নিয়ে সাগরের বুকে ফিরে এসেছে। এটাই এলাকার নদী সমূহের বৈশিষ্ট্য। শ্যামনগর-কালিগঞ্জের (সাতক্ষীরা) আদি যমুনা নদী পরিচয় তুলে ধরতে এ অঞ্চলের প্রথম ঐতিহাসিক সতীষ চন্দ্র মিত্র তাঁর যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন: গঙ্গা, ভাগিরথি নামে সপ্তগ্রাম (পশ্চিমবাংলা) পর্যন্ত আসে। এখান হতে যমুনা নামে প্রথমে চব্বিশপরগানা ও নদীয়া এবং পরে চব্বিশ পরগানা ও যশোরের সীমানার মধ্যবর্তী দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। যমুনা ক্রমে চৌবাড়িয়া, জলেশ্বর, ইছাপুর ও গোবরডাঙ্গা ঘুরে চারঘাটের কাছে টিপির মোহনায় এসে ইছামতি নাম ধারণ করে। ইছামতি সোজা দক্ষিণ দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করে বশিরহাট, টাকি হয়ে বাংলাদেশের দেবহাটার ধার দিয়ে কালিগঞ্জের বসন্তপুর-দমদমের মধ্য দিয়ে নাজিমগঞ্জের পূর্বধার হয়ে শ্যামনগরে ভুরুলিয়া দিয়ে শ্যামনগরে প্রবেশ করে। এখান থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে বংশীপুর (যেখানে বারুণের-ন হয়) যেয়ে দু’ভাগ হয়ে যমুনা নামে ডানমুখো হয়ে রমজাননগরের সোনাখালী ও শ্যামনগরের চিংড়ীখালির মধ্য দিয়ে মাদার নদীর সাথে মেলে। বংশীপুরে যমুনার অপর এক অংশ ইছামতি নাম নিয়ে বাম দিয়ে কদমতলী হয়ে মালঞ্চ হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। সুন্দরবনে প্রবেশ করা দু’ধারাই মালঞ্চ নামে আড়পাংশিয়া নদী হয়ে সাগর সংগমের প্রাক্কালে আবার যমুনা নাম ধারণ করে। ইছামতির বসন্তপুর-দমদম এলাকা হতে শুরু করে মাদার নদীর সংযুক্তি পর্যন্ত আদি যমুনা প্রায় ৩২ কিলোমিটার। এ নদীর সাথে ৪০টির বেশী বিল ও একই পরিমান খালের সংযোগ রয়েছে। মূলত উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ পথ দিয়ে ইছামতির মিষ্টি পানির প্রবাহ সাগরে এবং সাগরের প্রবাহ ইছামতিতে আসা যাওয়া করতো। এ আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে নদী ও সংযুক্ত খালসমূহের নাব্যতা স্বভাবিক, পরিবেশ সহিষ্ণু ও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত ছিল। আদি যমুনা নদী হলো সবচেয়ে ঐতিহ্য ও ইতিহাসখ্যাত নদী। এক সময় ইছামতি-আদি যমুনা-মাদার নদী হয়ে জাহাজ ভরে সওদা আসতো। বারো ভূইয়ার অন্যতম স্বাধীন নৃপতি প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল এ যমুনা কূলে। ‘যমুচ্ছোপ্রসঙ্গমে প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যশোহর ও ধুমঘাটের রাজধানী ছিল।’ এখনও টিকে আছে নৌপ্রতাশ্রয় জাহাজ ঘাটা। সনাতনী ধর্ম বিশ্বাসীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব বারুণের ¯œান এ যমুনাতে হয়ে আসছিল। এ যমুনা কূলে গড়ে উঠেছিল যশোরেশ্বী কালি মন্দির, ঐতিহাসিক মসজিদ ও উপমহাদেশের প্রথম র্গীজা। আদি যমুনা নদী সংলগ্ন জমিদার বাড়ি। শ্যামনগরের প্রধান মহাশ্মশান। এই যমুনা কূলে ছিল দোলযাত্রা উৎসব। যমুনা নদী থেকে মোঘল বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তৈরি করা ‘মাটির গড়’। ইছামতির কালিগঞ্জের দমদম (ভাড়াশিমলা) ও বসন্তপুর (মথুরেশপুর) মধ্য এলাকা হতে শুরু হওয়া আদি যমুনা নদী দু’কিলোমিটর পর নাজিমগঞ্জের পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিণ মুখো বাঁক নিয়ে শ্যামনগরের মধ্যদিয়ে সাগর মুখে ধাবিত হয়েছে। নাজিমগঞ্জের পার্শ্বের এ বাঁক হতে সোজা পূর্ব দিক মুখ করে বৃটিশ নীল কুঠিয়ালরা ব্যবসার সুবিধার জন্য আঠারো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে একটি সংযোগ খাল খনন করে। যেটি পরবর্তীতে কাকশিয়ালী নদী নামে পরিচিতি পায়। যোগাযোগের জন্য এ নদীটি কাটলেও পরবর্তীতে এ নদী উপক‚লীয় অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। তৈরী করে উপক‚লীয় এলাকার আন্তঃনদী সংযোগ। ইছামতি নদীর আদি যমুনা ছাড়াও আরো একটি ক্ষীণ শাখা ছিল। যেটা কালিন্দি নামে রায়মঙ্গলের সাথে যুক্ত হয়েছে। বসন্তপুরের উত্তর-পশ্চিম ধার দিয়ে চলে যাওয়া কালিন্দি প্রতাপাদিত্যের সময়ে সাধারণ খাল ছিল। বৃটিশ সরকার ১৮১৬ সালে কোলকাতার সাথে যোগাযোগ সহজ করতে কালিন্দি হতে একটি খাল কেটে বড় কলাগাছির নদীর প্রবাহের সাথে যুক্ত করে। এটি সাহেবখালির খাল নামে পরিচিত। এ খাল কাটার ফলে ইছামতির পানি ভাটায় এ পথে যাওয়া শুরু করলে কালিন্দি বড় হতে শুরু করে। এর আগেই গুড্ডল্যাড সাহেব যখন চব্বিশ পরগানার কালেক্টর তখন যমুনা থেকে একটি খাল কেটে বাশতলা দিয়ে খোলপেটুয়া নদীর সাথে যুক্ত করে। যা কাকশিয়ালীর খাল (এড়ড়ফষধফ পৎববশ) বলে পরিচিত। এরপর আরো নদীপথ সংক্ষিপ্ত করতে হাসনাবাদ খাল খনন করা হয়। বৃটিশ সরকার কর্তৃক বাণিজ্যিক কারণে এ তিনটি সংযোগ খাল কাটায় আদি ইছামতি-যমুনা নদীর প্রবাহ অনেকাংশে কমে যায়। গুড্ডল্যাড সাহেব ইছামতি হতে আসা আদি যমুনা নদীর নাজিমগঞ্জ বাজারের উত্তরপূর্ব ধার হতে কাকশিয়ালী খালটি খনন করে চম্পাফুল ইউনিয়নের উজিরপুরের ত্রিমোহনীতে গুতিয়াখালী ও হাবড়া নদীর সাথে যুক্ত করে। আগেই এখান থেকে ধারা ছিল। ফলে এলাকাটি ত্রিমোহনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সংযোগে ইছামতির সাথে হাবড়া ও গুতিয়াখালী নদীর সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পথ তৈরী হয়। সংযুক্ত খালটি গুতিয়াখালি নদীর সাথে মিশে ঘুরে দক্ষিণ মুখো হয়ে (উপরে বর্ণিত) কালিগঞ্জের বাঁশতলা ও আশাশুনির শ্রীউলার মধ্যবর্তী নদী গলঘেসিয়ার সাথে মিশে খোলপেটুয়ার সাথে যুক্ত হয়। আগে থেকেই উজিরপুরের নিকট হতে হাবড়া নদী উত্তর-পশ্চিম মুখো হয়ে দেবহাটার কুলিয়া ব্রিজের নীচ দিয়ে প্রবাহিত লাবণ্যবতী নদীর সাথে মিলিত ছিল। লাবণ্যবতী নদী ইছামতির কোমরপুর (দেবহাটার) হতে উঠে আসা একটি প্রবাহমান সংযোগ নদী। (ইছামতি নদীর কোমরপুর ***(যেখানে ¯øুইসগেট) কুমরোর খাল কুলিয়া ব্রিজের কাছে লাবণ্যবতী, টিকেট হয়ে কোলকাতার খাল হয়ে কদমখালি হয়ে বাকালের খাল মরিচ্চাপ নদীর সাথে যুক্ত। মরিচ্চাপের এল্লারচর এলাকা হতে খাজুর ডাঙ্গি পর্যন্ত কেটে বেতনার সাতে যুক্ত) লাবণ্যবতী নদী সাতক্ষীরা শহরের পশ্চিমাংশের খালসমূহের সাথে সংযুক্ত। কাকশিয়ালী ত্রিমহোনীতে যুক্ত হওয়ায় হাবড়ার এ শাখার প্রবাহ আরো গতিশীল হয়। ইছামতি নদীর পানি কোমরপুর দিয়ে ঘুরে আবার মরিচ্চাপে পড়ার পথ তৈরী হয়। দু’ধারার হাবড়া নদীর অপর ধারা উত্তর-পূর্ব মুখী হয়ে বদরতলা, শোভনালী, ব্যাংদহ হয়ে মরিচ্চাপের সাথে যুক্ত ছিল। মরিচ্চাপ সাগরযুক্ত খোলপেটুয়ার সাথে মিলিত প্রবাহমান নদী। অন্যদিকে মরিচ্চাপ নদীর সাথে সাতক্ষীরার বেতনা নদীর সংযোগ আগে থেকে ছিল। কাকশিয়ালী নদীর ধারা ত্রিমোহনীতে যুক্ত হওয়ায় মরিচ্চাপের প্রবাহ ইছামতির (কালিগঞ্জ) প্রবাহের সংযোগে সকল নদীর সংযোগ তৈরি করে। নদীসমূহকে প্রবাহময় করে। নদীপথে যোগাযোগের একটি আন্তঃঅঞ্চলীয় ব্যবস্থাপনা তৈরী হয়। পরবর্তীতে প্রাণসায়ের খনন করা হলে এ সংযোগ আরো গতিময় হয়। তখন বেতনা প্রবাহ খেজুর ডাঙ্গি হয়ে সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে এল্লাচ্চর হয়ে মরিচ্চাপে পড়া সহজ হয়। উপক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ করার সময় এ নদীসমূহের প্রবাহ বিবেচনা না করে, নদীর পানির সাথে আসা পলি ব্যবস্থাপনার বিষয় এবং এলাকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিবেচনা না করে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও ¯øুইস গেট নির্মাণ করে এ অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ধ্বংস করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলকে নিক্ষেপ করা হয় এক বৈরী পরিবেশের মধ্যে। ভেঙে যায় সৃজনশীল পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। নষ্ট হয় খাদ্য নিরাপত্তা বলয়। আগেই বলা হয়েছে, ইছামতি-আদি যমুনা নদী শুধু শ্যামনগর-কালিগঞ্জ উপজেলার নদী নয়, আজ সাতক্ষীরা, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা ও পানি প্রবাহের একমাত্র সম্ভাবনাময় ধারা। আর এ বাস্তবতার নিরিখে ইছামতি-যমুনার প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে জেলার ঝুঁকিতে থাকা প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা অনেকাংশে সম্ভব। এই সঙ্গে ইছমতির কোমপুরের দেবহাটার নিকট নির্মিত ¯ইসগেটটিও পরিবর্তন করে প্রবাহ স্বাভাবিক চলাচলের ব্যবস্থা করলে সামগ্রিক সাতক্ষীরা নিরাপদ হতে পারে জলাবদ্ধতার হাত থেকে। ২ ৩ বর্তমানে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে: 8,703,151 total views, 84 views today |
|
|
|