আব্বাস উদ্দীন, মণিরামপুর (যশোর): এবারও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যশোরের মণিরামপুরে এমপিও বঞ্চিত সাড়ে পাঁচশ শিক্ষকের পরিবার। এমপিও নামক সোনার হরিণের আশায় থেকে থেকে রীতিমত হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তারা। এমপিও নামের সোনার হরিণ কবে নাগাদ তাদের হাতে ধরা দেবে- সেই আশার প্রহর গুণতে গুণতে কারো কারো চাকুরি জীবন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সরকারি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশায় থেকে অন্য কোন পেশায় না যেয়ে বিনা বেতনে খেয়ে না খেয়ে কর্মস্থল আকড়ে ধরে জীবনের মূল্যবান সময় পার করেছেন এসব শিক্ষক। ফলে এসব শিক্ষক পরিবারে ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে চাহিদা মোতাবেক ঈদের কেনা কাটা করতে না পারায় এসব পরিবারের সদস্যরা ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিতই থাকছে।
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই নতুন পোশাকের বাহার- এর কোনটিরই দেখা মেলে না এসব নন এমপিও শিক্ষক পরিবারে। ঈদ আসে তাদের জন্য দুঃখ আর অভিশাপ হয়ে। ঈদ আসলে এসব পরিবারে নেমে আসে ভোগান্তি আর অশান্তি। স্ত্রী-সন্তানদের চাহিদামত নতুন পোশাক দিতে না পারায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারা। অনেকেই আবদার মেটাতে গিয়ে হয়ে পড়েন ঋণগ্রস্ত। যাদের সেই সমর্থটুকুও নেই চাপা কষ্টে বুধ ভারী হয়ে ওঠে তাদের।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় বেতনভাতাবিহীন এমন শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশ। আর ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৮টি। এরমধ্যে রয়েছে ৩৯টি এবতেদায়ী, ছয়টি নি¤œ মাধ্যমিক, ১৯টি মাধ্যমিক, আটটি দাখিল, পাঁচটি কলেজ এবং চারটি আলিম ও ফাজিল মাদরাসা।
এরমধ্যে ১০টি এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক নামমাত্র ১২০০ টাকা করে ভাতা পান। বেতনভাতা বিহীন এসব শিক্ষকরা কেউ কেউ কাজ করছেন ১০-১২ বছর, কেউবা আবার ২১ বছর। নন এমপিও এসব শিক্ষকরা কেউ কেউ গ্রাম্য চিকিৎসক, ছোট ব্যবসা এমনকি মাঠে বর্গা দিয়ে সংসারে কোনরকম দু’বেলা অন্ন যোগান। সারা বছর একটা ধারায় চললেও বিপত্তি ঘটে ঈদের মত বড় কোন উৎসবে। এই সময়ে বেতন ভাতা না পাওয়ার কষ্টে এসব শিক্ষকদের দম বন্ধ হয়ে আসে। একই সাথে চাকরি করা অন্য শিক্ষকরা যখন বেতন তুলে বাসায় ফেরেন তখন তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়া কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বললে এমনটি জানিয়েছেন তারা।
উপজেলার এইচ আর এইচ সম্মিলনী নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরিফুল ইসলাম জানান, বেতন বাদে জীবন কেমন চলে সেটা অবশ্যই আপনাদের জানা আছে, তারপরও বলছি, এই ঈদ আসলে কোন ঈদই না। মাসিক বেতন ছাড়া একজন শিক্ষকের জীবন কিভাবে কাটে সেটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। ঈদ আশাটা তাদের জন্য অভিশাপ। এটা একটা বঞ্চনা। সবাই যখন হাসি-খুশি মনে ঈদের মাঠে যান, সেটা দেখে এসব শিক্ষকরা যে স্ট্রোক করে মারা যান না, সেটাই আল্লাহর একটা রহমত।
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘২০০০ সালে এমএ পাশ করে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছি। ১৮ বছর ধরে বিনা বেতনে খাটছি। আমার প্রতিষ্ঠানে আট জন শিক্ষক কর্মচারী আছেন। তার মধ্যে দুই-তিন জন ধান কাটার মৌসুমে দিনমজুরির কাজও করেন।’ ইত্যা সুইজগেট দাখিল মাদরাসার সুপার রুহুল আমিন বলেন, ‘ঈদ বলতে চোখের পানি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈদ আসলে আমরা ছেলে মেয়েদের সামনে দাঁড়াতে পারি না। অনেক আশায় ছিলাম এবার এমপিও পাব। কিন্তু বাজেট ঘোষণা হওয়ার পর আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না। ২১ বছর ধরে আমরা ১৮ জন শিক্ষক কর্মচারী এখানে কাজ করছি। আর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা নেই।’ হাসাডাঙ্গা স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসার সুপার আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘১০-১২ বছর বিনা বেতনে চাকরি করছি। পল্লীতে চিকিৎসা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে। আমার প্রতিষ্ঠানের আলমগীর নামের এক শিক্ষকের দুইটা সন্তান। মাঠে কাজ না করলে তার ভাত জোটে না। এসব পরিবারে আবার ঈদ!’ ধলিগাতী সুন্দলপুর আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ এসএম ওয়াদুদ বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে আলিম পর্যায়ে ছয় জন শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা বেতন ভাতা পান না। ওদের সামনে আমরা যখন বেতন নিয়ে বাড়ি যাই, তখন সত্যিই লজ্জায় পড়তে হয়। এতবড় একটা উৎসবে তাদের হাতে কিছু দেওয়ার সুযোগ হয় না। ওরা খালি হাতে বাড়ি ফেরে!’ তিনি বলেন, ‘শুনেছি, পাড়দিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার শিক্ষকরা অর্থের অভাবে কেরোসিনও কিনতে পারেন না। রাতে তাদের সন্তানদের আলোর অভাবে পাটকাঠি জ¦ালিয়ে ভাত খেতে হয়। এটা সত্যিই লজ্জার ও দুঃখের।’ তবে বেতন, ভাতা ও বোনাসবিহীন এসব শিক্ষকদের ঈদ কষ্টে কাটলেও সবাই আশায় বুক বেধে আছেন; হয়ত সরকার তাদের দিকে তাকাবেন। দ্রুতই তাদের দুঃখ ঘুচবে। অন্যথায় তারা আবারও আন্দোলনে নামবেন, এমনটি জানিয়েছেন নন এমপিও শিক্ষকরা।
মণিরামপুরে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত সাড়ে পাঁচশ শিক্ষক পরিবার!
https://www.facebook.com/dailysuprovatsatkhira/